রবিবার, ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম
নন্দিত গীতিকবি মিলন খানের আজ শুভ জন্মদিন ভালোবাসি তোমায় সিনেমার ক্যামেরা ক্লোজ চৌদ্দগ্রাম প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন তৌহিদ সভাপতি, সম্পাদক সোহাগ, সাংগঠনিক ফারুক গানের হাট অডিও স্টুডিও এর শুভ উদ্বোধন হলো চলচ্চিত্রে অনুদানের অজুহাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের হরিলুট: সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী গান বাজনা সম্পর্কে কিছু কথা প্রসঙ্গ শুভ্র দেবের একুশে পদকঃ ফরিদুল আলম ফরিদ শেখ কামাল হোসেন এর কথা ও সুরে, চম্পা বণিক এর গাওয়া ‘একুশ মানে’ শিরোনামের গানটি আজ রিলিজ হলো নোয়াখালীতে প্রসূতিসহ নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকের মামলা, তদন্তে পিবিআই ‘দম’ সিনেমা নিয়ে ফিরছেন পরিচালক রেদওয়ান রনি

সিঙ্গাড়া আবিষ্কার এর অজানা কাহিনি

জ.নি. ডেস্ক :
  • প্রকাশ সময়ঃ রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩
  • ৬১ বার পড়া হয়েছে

II ‘সাম্বোসেক’ থেকে ‘সিঙ্গাড়া‘ II

সিঙ্গাড়া নিয়ে কবি ও ছড়াকার মোহিত ঘোষ-এর লেখা একটি ছড়া।

“সিঙ্গাড়া রে সিঙ্গাড়া
তোর যে দেখি শিং খাড়া,
গা টা বেজায় খসখসে
হাঁটু মুড়েই রোস বসে।

ফাটিয়ে দিলে তোর ভুঁড়ি
নোলায় লাগে সুড়সুড়ি,
পাই ভেতরে এক কাঁড়ি
জোর মজাদার তরকারি।”

সিঙ্গাড়া’র ইতিহাস অনেক পুরনো। বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে সবার প্রিয় ভালোবাসার সিঙ্গাড়া আদতে কোন বাঙালী খাবারও নয়! সিঙ্গাড়ার জন্ম বাংলাদেশ কিংবা ভারত কেন এই উপমহাদেশেই নয়। একদল ইতিহাসবিদের মতে, ফার্সি শব্দ ‘সাম্বোসেক’ থেকেই এই সিঙাড়া শব্দের উৎপত্তি। তাদের দাবি, তুর্কি বীর সুলতান মাহমুদ গজনভি’র (৯৭১–১০৩০) রাজদরবারে এক ধরণের নোনতা মুচমুচে খাবার পরিবেশন করা হতো। যার মধ্যে কিমা, শুকনো বাদাম জাতীয় অনেক কিছু দেওয়া হতো। এটাই নাকি সিঙ্গাড়ার আদি রূপ। সমোসা/সামুসা/সিঙ্গাড়া যে নামেই ডাকি না কেন এর উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়াতে। আবার ঐতিহাসিকদের মতে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সিঙ্গাড়ার জন্ম পারস্যে অর্থাৎ কিনা বর্তমান ইরানে। নবম শতাব্দীতে পারস্যের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর, কড়াই শুঁটি, রসুন ও মাংস মেখে সেঁকে খেত। এরপরে এটি আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

হিন্দুকুশ পেরিয়ে মধ্য এশীয় তুর্কি রাজবংশের ভারতবর্ষ আগ্রাসন এবং বিভিন্ন ভাগ্যান্বেষী ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে উত্তর ভারতে এসে পৌঁছায় ত্রিকোণাকৃতি এই সুস্বাদু স্ন্যাকস, সামোসা। গঙ্গার অববাহিকা অঞ্চলে পৌঁছে মাংসের পরিবর্তে সবজি, পনির দিয়ে তৈরী হতে শুরু করলো সামোসা। ধনে, জিরে, গোলমরিচ, আদা-র মতো মশলা যোগ হয়ে খাঁটি ভারতীয় হয়ে উঠলো সে। আর বাঙালীদের কাছে হয়ে গেলো সিঙ্গাড়া। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অঙ্গীভূত করে ভারতের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়লো প্রত্যেক রাজ্যে তার আলাদা আলাদা স্বাদ নিয়ে। মোঘল আমলে খাবারটি এদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে সিঙ্গাড়া’র জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আর বিতর্ক থাকলেও এ উপমহাদেশে আসার পর যে এর স্বাদ আর উপকরণে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই!

সামোসা এবং এর বিভিন্ন সংস্করণ উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা থেকে পশ্চিম চীন পর্যন্ত জনপ্রিয় প্যাস্ট্রি এবং ডাম্পলিংয়ের পরিবারভূক্ত। এই স্ন্যাকসটি বাংলা এবং বাঙালীদের উচ্চারণেই কেবল সিঙ্গাড়া। সিঙ্গাড়াকে হিন্দিতে ‘সামোসা’ বলা হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত খাবার সামুচা আর সিঙ্গাড়া কিন্তু এক বস্তু নয়। সামুচা’র তৈরী প্রক্রিয়া এবং ভিতরে দেওয়া পুরও একরকম নয়। একই বস্তু সিঙ্গাড়া, কেবল নামে ‘সামোসা’ হয়ে তুমুল জনপ্রিয় ভারতের অনেক জায়গায়। বর্তমানে সিঙ্গাড়া খাবারটি ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালীদের কাছে নাস্তা হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।

✪ সিঙ্গাড়ার টাইমলাইন

৯ম শতক

ঐতিহাসিকদের মতে, ৯ম শতকে পারস্য অর্থাৎ ইরানের অধিবাসীরা যব এবং ময়দার তালের সঙ্গে গাজর, কড়াইশুঁটি, রসুন ও মাংস মেখে সেঁকে খেতো, যাকে বর্তমান সিঙ্গাড়ার জনক হিসাবে ধরা হলেও, সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেও তাঁরা ময়দার তালে মাংসের কুঁচি ঢুকিয়ে সেঁকেই খেতেন। এরও বহু বছর পরে তাঁরা ভারতবর্ষের উত্তরপূর্ব উপকূলের বঙ্গদেশে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর তরকারি, ময়দার তালের ভেতর ঢুকিয়ে ঘিয়ে ভেজে সিঙ্গাড়া তৈরির পদ্ধতি দেখে চমৎকৃত হ’ন।

পারস্যের ৯ম শতকের কবি ইসহাক আল-মাওসিলি তাঁর একটি কবিতায় সিঙ্গাড়া’র গুণগান করেছেন। তবে, তাঁর কবিতায় ‘সামোসা’ নামটাই পাওয়া যায়। তুর্কি বীর সুলতান মাহমুদ গজনভি’র (৯৭১–১০৩০) রাজদরবারে এক ধরণের মজাদার নোনতা মুচমুচে খাবার পরিবেশন করা হতো। যার মধ্যে মাংসের কিমা, আখরোট, আমন্ড আর নানা গরমমশলা দেওয়া হতো। এটাই নাকি সিঙ্গারা অর্থাৎ কিনা সামোসা’র আদি রূপ। এখান থেকেই সামোসা’র দিকবিজয়ের পালা শুরু। তার সাথেই শুরু আঞ্চলিক রাঁধুনিদের কেরামতিতে সেই বেদুইন আমিষ সামোসাকে স্থানীয় স্বাদের মিশেলে আপন করে নেওয়ার। বাংলায় আসার পর বাঙালী তাতে ভরেছে বিভিন্ন মশলা সহযোগে তৈরি আলুর পুর।

১০ম শতক

১০ম শতকেও মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা স্ন্যাকস্ হিসেবে ‘সাম্বোসেক’ নিয়ে ঘুরতেন। ফার্সি শব্দ সাম্বোসেক থেকেই সামোসা নামের উৎপত্তি। তারা সারাদিন ব্যবসার কাজে পথে পথে ঘুরে রাতে যে সরাইখানায় অাশ্রয় নিতেন সেখানে ময়দার খোলের মধ্যে মাংসের পুর ভরে তৈরি করতেন সাম্বোসেক বা সামোসা। ঘোড়া বা উটের পিঠে রাখা তাদের ঝোলায় থাকত সেই খাবার। মাংসের পুর ভরা এই খাবার অনেকক্ষণ ভালো থাকতো বলে এটি পথের খাবার হিসেবে নিতেন তারা। এই ইরানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাম্বোসেক বা সাম্বুসা এসে পৌঁছায় ভারতে।

১১শ শতক

১১শ শতকে গজনীর সুলতানদের দরবারে ছোট ছোট আকারে তৈরি সামোসা বা সাম্বোসা নামের এই পদটি রাজকীয় খাদ্যসম্ভারের অংশ ছিল বলে জানিয়েছেন ইরানি ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বায়হকি Abu’l-Fazl Bayhaqi (৯৯৫-১০৭৭) তাঁর ফার্সি ভাষায় লেখা ‘তারিখ-এ-বায়হকি’ গ্রন্থে। বিভিন্ন রকমের বাদাম, শুকনো ফল আর মাংসের কিমা দিয়ে তৈরী পুর ভরে ভাজা হতো এই সামোসা।

১৩শ শতক

১৩শ শতকে দিল্লি সালতানাতের রাজকবি ও বিখ্যাত ইতিহাস প্রণেতা আমির খসরু (১২৫৩-১৩২৫) সামোসা’র কথা উল্লেখ করেছেন তার গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন যে রাজকুমারগণ ও আমাত্যরা “মাংস, ঘি, পেঁয়াজ ও বিভিন্ন মসলার পুর দিয়ে প্রস্তুত সামোসা উপভোগ করতেন।”

১৩শ শতকের বাগদাদের রান্নার বই ‘কিতাব উল তাবি’কে তিন ধরনের সাম্বোসেক-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ফারাক তাদের পুরের বাহারে। মাংসের সাথে গরম মশলার পুর তো আছেই, তাছাড়াও মুখ মিষ্টি করতে যোগ হয়েছে হালুয়ার পুর। এছাড়াও চিনি আর আমন্ডের পুর দেওয়া মিষ্টি সাম্বোসেকও তখন তৈরি হচ্ছে বাগদাদের রসুইয়ে। সানবোসগ বা সানবুশক এমনি বহু নামেই নানা বইয়ে মধ্যে এশিয়া থেকে দক্ষিণ পূর্বের দিকে এই খাদ্যরত্নের পরিচয় নানা সময়ে।

১০ম থেকে ১৩শ শতকের এ সময়কালে আরবের রান্নাবান্না নিয়ে যেসব বই পাওয়া যায় সেখানে ‘সনবসাসক’, ‘সনাবাস্ক’ এবং ‘সানবাসাস’ ইত্যাদি নাম মেলে, এই শব্দগুলি ফার্সি। নামগুলো যে সিঙ্গাড়া বা সামোসা সম্পর্কিত তা বোঝাই যায়। আর এই নামগুলো থেকেই যে সিঙ্গাড়া শব্দটি এসেছে সেটাও বিষদ গবেষণার অবকাশ রাখে না।

১৪শ শতক

১৪শ শতকে মহম্মদ বিন তুঘলকের দিল্লির রাজদরবারেও পরিবেশন করা হত সিঙ্গাড়া। মরক্কো থেকে আগত প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা’র (১৩০৪ – ১৩৬৮) বর্ণনায় আমরা সেটা পাই। তবে ইবনে বতুতার লেখায় তার নাম ছিল ‘সম্বুসক’। সেই সিঙ্গাড়ায় পুর হিসেবে মাংসের কিমার সঙ্গে থাকত আখরোট, পেস্তা, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম ও নানা ধরণের মশলা।
সম্বুসক নামের সিঙ্গাড়া খাবারটি রয়্যাল স্ন্যাকস্-এর মর্যাদা পেত বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

১৪শ ও ১৫শ শতক

১৪শ ও ১৫শ শতকের মাঝামাঝি মালওয়ার সুলতান গিয়াস আল দ্বীন খিলজী (১৪৬৯-১৫০০)-এর রাজসভায় পরিবেশিত হত সিঙ্গাড়া। ফার্সি ভাষায় লেখা পঞ্চদশ শতকের কুকবুক ‘নিয়ামতনামা’য় সে সভায় প্রায় আট রকম সিঙ্গাড়া পরিবেশন করার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কোনটায় থাকত পাঁঠার মাংসের পুর, কোনটায় হরিণের মাংস। বাদাম, গোলাপজল, এলাচ, শুকনো দুধ দিয়েও মিষ্টি পুর ভরা সিঙ্গাড়ার চল ছিল সে সময়ে।

১৬শ শতক

কালের প্রবাহে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ এই মাংসের আর নানা মশলার সাথে মেশানো পুরের তিনকোণা ময়দার মোড়কে ভাজা নাস্তাটিকে আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে করে তুলেছেন নিজেদের সংস্কৃতির অঙ্গ। ১৬শ শতকে (১৫০৫–১৯৬১) পর্তুগিজরা যখন ভারতে প্রথম উপনিবেশ স্থাপন করল তখন তাদের সঙ্গেই ভারতে চলে এলো ‘বাটাটা’। বাংলায় যে চমৎকার সবজিটিকে বলা হয় ‘আলু’। আর এসেই বাঙালী রান্নাঘরের সিংহভাগ দখল করে বসলো। তারপর এ দেশে আলুর ব্যবহার শুরু করা থেকেই মাংসাশী সিঙ্গাড়ার পেটের মধ্যে কিমার বদলে ঢুকে পড়ল আলুর পুর। নিরামিষ পদের তালিকায় যুক্ত হলো আলুর পুর দেওয়া সিঙ্গাড়া। আর সেই রেসিপিতেই মাত তামাম ভারতীয় উপমহাদেশ। সেই যে আলুর পুর ভরা সিঙ্গাড়ার জয়যাত্রা শুরু হল, এখনো সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

১৬শ শতকের মোঘল শাসনামলে (১৫২৬–১৮৫৭) এদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করা ‘সানবুসাহ’ তৈরী হতো, যার অস্তিত্ব ছিল সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে। তার ভিতরে মাংসের কিমা, পেঁয়াজ এবং বিভিন্ন রকম বাদাম থাকতো। ১৬শ শতকে আবুল ফজল ইবন মুবারক কর্তৃক ‘আইন-ই-আকবরি’তে হিন্দুস্থান তথা ভারতবর্ষের মানুষের প্রিয় আমিষ খাবার হিসেবে ‘সানবুসাহ’ নামে সিঙ্গাড়ার উল্লেখ রয়েছে। ফার্সি ভাষায় লেখা এই গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন বাদশাহ আকবরের রাজদরবারের নবরত্নের একজন।

১৮ শতক

অনেকের মতে, সিঙ্গাড়ার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া’র কৃষ্ণনগর শহরে। ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র-এর রাজসভার রাজ-হালুইকর, কলিঙ্গ (বর্তমান উড়িষ্যা) থেকে আগত গুণীনাথ হালুইকরের ষষ্ঠ পুত্র গিরীধারী হালুইকরের স্ত্রী ধরিত্রী বেহারা আবিষ্কার করেছিলেন সিঙ্গাড়া। সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে ধরিত্রীদেবী আবিষ্কার করেছিলেন এই অসাধারণ খাদ্যদ্রব্যটির, যেটি সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা থেকে সারা ভারতবর্ষে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ঠাকুরবাড়িতেও কিন্তু সিঙ্গাড়া বানানো হতো। পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইতে লেখিকা সিঙ্গাড়া বানানোর পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে গেছেন।

এসবের বাইরেও তুরস্কের গনুল কান্ডাস-এর লেখা ‘টার্কিশ টেবল’ (Turkish Table) নামে একটি পৃথিবী-বিখ্যাত রান্নার বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায় যে বইটিতে পর্যন্ত সিঙ্গাড়ার রেসিপি দেওয়া আছে। যদিও সিঙ্গাড়ার বদলে তার নাম এখানে Nimet Pastry, যার মধ্যে আলুর পুরের পরিবর্তে মাংসের পুর দেওয়া আছে, কিন্তু বস্তুটি আদতে সিঙ্গাড়াই।

সাম্বোসেক’ নামের উৎপত্তি

খাদ্য ইতিহাসবিদ কলিন টেলর সেন তাঁর ‘ফিস্টস অ্যান্ড ফাস্টসঃ আ হিস্ট্রি অফ ফুড ইন ইন্ডিয়া’তে বলছেন, ‘সাম্বোসেক’ শব্দের সা বা সহ কথাটি একটি আরবি শব্দ যার অর্থ তিন। যেমন সহ তার বা সেতার যা আমরা তিন তারের বাদ্যযন্ত্র হিসাবে চিনি। আর আম্বোস কথাটার আরবি অর্থ এক বিশেষ ধরণের রুটি। দুয়ে মিলে তিনকোণা রুটির মোড়কে মোড়া সুস্বাদু স্ন্যাকস্। যা কি না সহজেই বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় ভ্রমণের সময়ে। তাই বেদুইন ব্যবসায়ীদের বোহেমিয়ান জীবনের এক মনপসন্দ খাবার ছিল এই মাংসের কিমা ভরা ‘সাম্বোসেক’।সি

✪ ঙ্গাড়া নামের উৎপত্তি

সিঙ্গাড়া দেখতে অনেকটাই তিন শিং-ওলা পানিফলের মতো লাগে দেখতে। পানিফল-এর সংস্কৃত নাম ‘শৃঙ্গাটক’। সংস্কৃত এই ‘শৃঙ্গাটক’ শব্দ থেকেই সিঙ্গাড়া নামের উৎপত্তি।

সংস্কৃত শৃঙ্গাটক > প্রাকৃত সিংগাড > বাংলা শিঙ্গাড়া, শিঙ্গারা, শিঙাড়া, সিঙাড়া, সিঙ্গাড়া।

মতান্তরে, সংস্কৃত সমভুজা শব্দ থেকে সিঙ্গাড়া নামের উৎপত্তি।

সংস্কৃত সমভুজা > সম্ভোজা > সিভুসা > সিঁঙুরা (পশ্চিমবাংলার নদিয়ার কথ্য ভাষার প্রভাবে) > শিঙাড়া, সিঙ্গাড়া।

সামোসা নামের উৎপত্তি

সিঙ্গাড়াকে হিন্দিতে বলে ‘সামোসা’। ‘সামোসা’ এসেছে সংস্কৃত ঐ ‘সমভুজা’ থেকে।

সংস্কৃত সমভুজা > সম্ভোজা > সাম্ভোসা > হিন্দি সামোসা।

সিঙ্গাড়ার বিভিন্ন নাম

ফার্সি শব্দ ‘সাম্বোসেক’ থেকে এই ‘সামোসা’ শব্দের উৎপত্তি। এই সিঙ্গাড়াই ভারতে যেমনি ‘সামোসা’ , তেমনি আরব দুনিয়ার ‘সানবাসাজ্জ’ বা ‘সানবাজাজ’, আফগানিস্তানে ‘সাম্বোসা’, পাকিস্তানে ‘সমসা’, তাজিকিস্তানে ‘সাম্বুসা’, তুরস্কে ‘সামসা’, ইরানে ‘সম্বুজা’, আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে ‘স্যাম্বুসা’ এবং মোজাম্বিক ও পর্তুগালে এমনকি ভারতের গোয়ায় ‘চেমুকা’ নামে পরিচিত।

যথেষ্ট মোটা ময়দার আবরণে মাটন কিমার পুরে ভরা ভারতের হায়দারাবাদের প্রসিদ্ধ সিঙ্গাড়ার নাম ‘লুখমি’। তবে সেটি দেখতে আয়তাকার; তিনকোণা নয়। ‘লুখমি’ নামটি এসেছে উর্দূ শব্দ ‘লুকমা’ থেকে যার অর্থ এক কামড় পরিমাণ বা অল্প পরিমাণ। গুজরাটের ‘সামোসা’ ছোট্ট ছোট্ট আকারের হয়, ভিতরে থাকে ফ্রেঞ্চ বিনস ও মটরশুঁটির পুর। নানা প্রাণীর মাংসের পুর দেওয়া একই খাবারের নাম আগেই বলেছি আবার গোয়ায় হয়ে যায়, ‘চেমুকা’। দক্ষিণ ভারতের বেশিরভাগ জায়গাতেই বাঁধাকপি, গাজর ও কারি পাতা দিয়ে তৈরি হয় সামোসা’র পুর। আর এপার ওপার দুই বাংলায়ই সিঙ্গাড়ায় মূলত আলুর পুর থাকে। তবে শীতের সময় ফুলকপি, কড়াইশুঁটিও জায়গা করে নেয় এর ভেতরে।

সিঙ্গাড়ার বিভিন্ন পুর

নামের মতোই সিঙ্গাড়ার পুরেও ভিন্নতা রয়েছে দেশ এবং অঞ্চলগুলভেদে। আরব দেশগুলিতে সিঙ্গাড়ার পুরে মাংস ছাড়াও থাকে আখরোট, বাদাম, পেস্তা, কাজু, কিশমিশ প্রভৃতি। মোগল আমলের সিঙ্গাড়ার পুরেও মাংস এবং দামি মশলার চল ছিল সে কথা ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকেই জানা যায়। পাকিস্তান, তুরস্ক, আফগানিস্তানের কোনও কোনও অঞ্চলের সিঙ্গাড়ার পুরে এখনও মাংস দেওয়ার চল আছে।ভারতের গুজরাটে সে ধরা দিয়েছে পাত্তি সামোসার অবতারে। আর পাঞ্জাব তাকে চিনেছে পনীর সামোসার অবয়বে। হাল আমলের ফিউশনের যুগে সিঙ্গাড়ার মধ্যে পনিরের পুর আবার কোথাও চীনা খাবার চাউমিন আলাদাভাবে মশলা দিয়ে ভেজে সিঙ্গাড়ার পেটে পুর হিসেবে চালান করে দেওয়া হয়েছে। এরকম বাহারি সিঙ্গাড়ার দেখাও আজকাল মেলে। জানা যায়, দিল্লিতে নাকি আবার গলানো চকোলেট ভরে ভেজে তোলা চকোলেট সামোসাও পাওয়া যায়। অবশ্য মিষ্টি ক্ষীরের সিঙাড়া অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। নানা জায়গায় এর সঙ্গে চাটনিও দেওয়া হয়।

ভারতের দিল্লি, রাজস্থান, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের সিঙ্গাড়া বা সামোসায় কোথাও কোথাও আলু, মটর ছাড়াও পনির এমনকি শুকনো ফলও পুর হিসেবে চলে। পাশাপাশি সিঙ্গাড়ার সঙ্গে পুদিনা, ধনেপাতা, রসুন-কাঁচালঙ্কার চাটনিরও চল রয়েছে। অঞ্চলভেদে নামই যে কেবলমাত্র ভিন্ন তা নয়, স্বাদও আলাদা কারণ, সিঙ্গাড়ার পুরে ব্যবহৃত মশলাতেও রয়েছে ভিন্নতা।

সিঙ্গাড়া তৈরি করবেন যেভাবে

উপকরণ:
ময়দা ২ কাপ, বড় আলু সিদ্ধ ১ টি, ফুলকপির গোটা দশেক ছোট টুকরো, কড়াইশুঁটি আধ কাপ, মৌরি আধ চা চামচ, গোটা জিরে আধ চা চামচ, ভাজা জিরে গুঁড়ো আধ চা চামচ, কাঁচা লঙ্কা ২টি, আদা বাটা ২ চা চামচ, দারচিনি গুঁড়ো ১ চা চামচ, নুন-চিনি স্বাদ মতো।

প্রণালী:
ময়দায় সামান্য নুন ও পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল দিয়ে ময়ান দিন। ফুলকপি ছোট টুকরো করে ভাপিয়ে নিন। তেল গরম হলে গোটা জিরে, মৌরি ও আদা বাটা ফোড়ন দিন। এর মধ্যে সব মশলা, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি ও আলু দিয়ে ভাল করে নেড়ে নিন। ময়দা থেকে লেচি কেটে রুটি বেলে নিন। মাঝখান থেকে দু’ভাগে কেটে তিনকোণা করে মুড়ে ঠোঙার মতো বানিয়ে তার মধ্যে আলু-ফুলকপি ইত্যাদির পুর ভরে মুখটা সামান্য জল মাখিয়ে চেপে বন্ধ করে তেলে ভেজে নিন।

পাড়ার তেলেভাজার দোকান থেকে মিষ্টির দোকানে বাঙালীর একান্ত নিজস্ব স্ন্যাকস্ বলতে এই তিনকোণা আকৃতির পুরভরা সুস্বাদু সিঙ্গাড়া, যা অনেকক্ষণ গরমও থাকে। যুগ যুগ ধরে কত শীত-বর্ষা এল গেল সিঙ্গাড়া কিন্তু বাঙালী জীবনে লেপ্টেই আছে, ঠিক আগের মতো। সিঙ্গাড়া হচ্ছে বাংলা ও বাঙালীর অর্থ-সমাজ-রাজনীতির অমোঘ উপকরণ। সিঙ্গাড়া না থাকলে বাঙালী ঘরের কনে দেখা পর্বটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হয় না। সিঙ্গাড়া না থাকলে মাঠে মারা যায় উদীয়মান কবি-লেখকদের কবিতা-গল্প পাঠের আসর।

গত তিন-চার দশক ধরে উভয় বাংলায় অবাঙালী খাদ্যের আগ্রাসন যেভাবে ঘটে চলেছে তাতেও সিঙ্গাড়ার মনে হয় না কিছু এসে যাবে। রোল-চাউমিন-মোমোর একচেটিয়া আধিপত্যেও তো সে আগের মতোই বিরাজমান। শহুরে অভিজাত পরিবারের বৈঠকখানায় মোটা গদির সোফায় বসা অতিথির থালাই হোক বা প্রত্যন্ত গ্রামের জরাজীর্ণ চায়ের দোকানের সামনে নড়বড়ে বাঁশের বেঞ্চে রাখা তেলচিটে কালো ভাঙ্গা বাঁশের ঝুড়ি – বিকেলই হোক বা সকালই হোক, সিঙ্গাড়া সর্বত্র সর্বদা সর্বগামী। আর দেশী ঘিয়ে ভাজা হোক বা সাদা তেলে, সিঙ্গাড়ার আবেদনে সাড়া দেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তাই বাঙালীর গ্যাস, অম্বল, চোঁয়া ঢেকুর যতই থাকুক; সিঙ্গাড়া ছিল, আছে এবং থাকবে।

সূত্র: মীর শাহনেওয়াজ (Mir Shahnewaz) এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত।

.

দয়া করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
April 2024
S M T W T F S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031