ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর-
মিডিয়ার এক ছোটভাই অনেকগুলো প্রশ্ন পাঠিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম প্রসঙ্গে। সম্ভবত এটা নিয়ে সে কাজ করছে। যেহেতু প্রশ্নগুলো অনেকেরই জানা প্রয়োজন, তাই উত্তরগুলোও এখানে দিলাম:
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ওভার দ্য টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্ম এ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনে কি কি সংকট ও সম্ভাবনা রয়েছে?
প্রথমেই বলে রাখি, আমরা যদিও এটাকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বলছি পশ্চিমা বিশ্বে এটার নাম ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম দুই প্রকার। সাবস্ক্রাইবার বা গ্রাহক ভিত্তিক (যেটা সাবস্ক্রাইব করতে টাকা দিতে হয়), আরেকটা হলো বিজ্ঞাপন ভিত্তিক (যেটা সাবস্ক্রাইব করতে টাকা দিতে হয়না)। এর বাইরেও আরো এক ধরনের ওটিটি প্লাটফর্ম করা যায় যা পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত প্রচলিত হয়নি। পদ্ধতিটা কি?
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে-What you get free, is of no use, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘বিনে পয়সায় পাওয়া কোন কিছুর মূল্য নেই’। এই জন্যই বিষয়টি আমি তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখলাম যাদের টাকা খরচ করে তথ্য জানার যোগ্যতা আছে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়ে লাভ করতে হলে প্রথমেই ওই প্ল্যাটফর্মে পর্যাপ্ত সংখ্যক গ্রাহক যোগাড় করার লক্ষ্যে একটানা অন্তত ৫-৬ মাস কন্টেন্ট, যেমন ওয়েব সিরিজ, ওয়েব ফিল্ম, নাইন্টি-মিনিটস ফিল্ম এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে হবে। এরও আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওই প্ল্যাটফর্ম কি পেইড গ্রাহক ভিত্তিক নাকি বিজ্ঞাপন ভিত্তিক।
প্রথম ছয় মাস ওটিটি প্ল্যাটফর্মটা টার্গেটেড দর্শক বা গ্রাহকের কাছে পরিচিত করার লক্ষ্যে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম, যেমন ফেইসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার ইত্যাদিতে ব্যাপক হারে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। এরও আগে ফেইসবুক এবং টুইটারে ওই প্ল্যাটফর্মের পেইজ খুলে সেগুলোয় পর্যাপ্ত ফলোয়ার সংগ্রহ করার লক্ষ্যে বুষ্ট করতে হবে অকৃপণভাবে।
মানে, একটা প্ল্যাটফর্ম চালুর পূর্ব মুহূর্তে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে পেইজ খুলে সেগুলোর পেছনে প্রথম তিন মাস অন্তর এক কোটি টাকা খরচ করতে হবে শুধু বুষ্ট খাতেই। টার্গেট থাকতে হবে অন্ততপক্ষে পঞ্চাশ লাখ ফলোয়ার। এক্ষেত্রে পেইজগুলো বুষ্ট করার সময় সেগুলোতে আকর্ষনীয় টিজার, ট্রেইলার, প্রোমো ইত্যাদি দিতে হবে।
পেইজগুলোতে কাঙ্ক্ষিত ফলোয়ার আসার পর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এক নাগাড়ে কন্টেন্ট ছাড়তে হবে। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে একটা ওয়েব সিরিজ, ২/৩ টা ওয়েব ফিল্ম, ২/৩ টা নাইনটি মিনিটস ফিল্ম এবং ১/২ টা পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
প্রত্যেকটা কন্টেন্ট মুক্তি দিয়ে এগুলোর প্রোমো, টিজার, ট্রেইলার ইত্যাদি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের পেইজে ছেড়ে সেগুলো ব্যাপকভাবে বুষ্ট করতে হবে। অর্থাৎ, প্রত্যেকটা কন্টেন্ট প্রমোট করার পেছনেই মাসে অন্ততপক্ষে ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে।
এভাবে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্ল্যাটফর্ম চালু হলে এটায় চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়ে অবশ্যই মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
প্রশ্ন: ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সাধারণত দর্শক কারা? তাদের বয়স কেমন এবং পেশা কি?
উত্তর: ওটিটি প্ল্যাটফর্ম প্রাপ্ত বয়স্কদের বিনোদন মাধ্যম। এটার টার্গেট দর্শক ১৮ বছর থেকে শুরু করে উপরে। কোনো প্ল্যাটফর্ম পেশায় ভিত্তিতে চলেনা। এগুলো চলে সমাজের শ্রেণীগুলোকে টার্গেট করে। একটা কথা সবার মনে রাখা দরকার। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হোক কিংবা ইউটিউব চ্যানেল বা টেলিভিশন চ্যানেল, ব্যবসায়ীরা কিন্তু এগুলোর মূল দর্শক নয়। কারণ, ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততার কারণে তাদের পক্ষে সাধারণত একটানা অনেকক্ষণ কোনো বিনোদনের পেছনে ব্যয় করা মুশকিল। তবু ব্যবসায়ীরা ওটিটি কন্টেন্ট দেখে। এক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ মূলত অ্যাকশন থ্রিলার, এডাল্ট কন্টেন্ট ইত্যাদির দিকেই বেশি থাকে। প্রেম নিয়ে অহেতুক ঘ্যানর ঘ্যানর ইত্যাদির দিকে ব্যবসায়ীরা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না।
তাই বাংলা কন্টেন্ট নির্ভর ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মূল দর্শক প্রবাসী বাঙ্গালী, চাকরিজীবী, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং বয়স্ক শ্রেণী।
প্রশ্ন: বর্তমানে দেশীয় ও বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ কি কি?
উত্তর: বর্তমানে বাংলাদেশে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম যেগুলো আছে সেগুলো কি এক নম্বর প্রশ্নের উত্তরে আমি যা বললাম সেটা অনুসরণ করে চালু হয়েছে? না হয়ে থাকলে এগুলোর পক্ষে সাফল্যের মুখ দেখা কঠিন হবে। বিদেশী ওটিটি প্ল্যাটফর্মে আমাদের চলচ্চিত্র চালাতে বাঁধা নেই। কিন্তু আমাদের তালেবান গোছের সেন্সরবোর্ড বিলুপ্ত না করা হলে বাংলাদেশের সিনেমার জন্যে আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে জায়গা পাওয়া কিংবা কাঙ্ক্ষিত হওয়া প্রায় অসম্ভব।
তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নাটকের আয়োজন এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে যে সিনেমাগুলো নির্মিত হচ্ছে সেগুলোর পক্ষে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্যে সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ বা ওয়েবফিল্ম, যা-ই বানানো হোক, সেগুলোর ক্ষেত্রে আধুনিক ক্যামেরা (যেমন রেড ড্রাগন), আধুনিক এডিটিং, আধুনিক ডাবিং (ডলবি সাউন্ড সিস্টেম, যা এখনও বাংলাদেশে নেই), কালারিং, স্পেশাল ইফেক্ট ইত্যাদি লাগবে। গল্প বাছাই, কষ্টিউম, লোকেশন, চিত্রধারণ পরিকল্পনা, ডিজিট্যাল লাইটিং, থ্রি-ডি মেকাপ ইত্যাদিও লাগবে। মোদ্দা কথায়, দশ, বিশ কিংবা ত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে সিনেমা বানিয়ে সেটা আন্তর্জাতিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চালানোর স্বপ্ন দেখে কোনো লাভ নেই। ওগুলোর জন্যে সিনেমা বানাতে হলে অন্তত ২-৩ কোটি টাকার বাজেট লাগবেই।
আরো সহজ করে বলি? আমরা বিদেশে তৈরী পোশাক রপ্তানি করি। কিন্তু দেশের কোনো এক গ্রামে হাতে চালানো সেলাই ম্যাশিন দিয়ে জামাকাপড় সেলাই করে সেগুলো কি বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব? আন্তর্জাতিক বাজারের জন্যে আন্তর্জাতিক মান ধরে রেখেই সিনেমা বানাতে হবে।
প্রশ্ন: ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এই চলচ্চিত্র শিল্প কি ঘুরে দাড়াতে পারবে?
উত্তর: ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হলো আগামী দিনের সিনেমাহল। এটা মাথায় রাখতে হবে। এখন বিশ্বে মোট সিনেমা হলের সম্মিলিত দর্শক সংখ্যাটা যতো এর পাঁচ শ গুন বেশি হবে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এর দর্শক।
একটা কথা বলে রাখি। বাংলাদেশে কিন্তু চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে স্বীকৃত নয়। এটা এখনও সেক্টর। তাই চলচ্চিত্র শিল্প বললে ভুল হবে।
প্রশ্ন: ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাবার সম্ভাবনা কতটুকু?
উত্তর: এটার উত্তর উপরে দিয়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সিনেমা শিল্পের জন্য আর্শীবাদ না অভিশাপ?
উত্তর: দর্শকের সংখ্যা বাড়লে এটা অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ? আসল কথা হলো, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চলচ্চিত্রের জন্যে আশীর্বাদ। কিন্তু আমরা এখনও ওসব প্ল্যাটফর্মে চালানোর মতো সিনেমা নির্মাণ করছি না। আমাদের সিনেমাগুলো হয়ে গেছে অল্প বাজেটের লম্বা নাটক। আর কিছুই না।
প্রশ্ন: ওটিটি প্লাটফর্ম কি সিনেমা হলের বিকল্প হতে পারে?
উত্তর: মোবাইল ফোন কি ল্যান্ডফোনের বিকল্প হয়েছে? প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে এভাবেই অনেককিছু বদলে যাচ্ছে – যাবে।
প্রশ্ন: ওটিটি প্লাটফর্ম কি? সিনেমার সাথে এর সম্প্রিক্ততা কতটুকু, এর ভবিষ্যত কেমন? চলচ্চিত্র প্রদর্শনে এর সীমাবদ্ধতা কি? সেখান থেকে কিভাবে উত্তরন করা যায়? সরকার কি কি ব্যবস্থা নিতে পারে।
উত্তর: এগুলোর উত্তর আগেই দিয়েছি। আবার বলছি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হলো হাওয়াই সিনেমা হল, যা চোখে দেখা যাওয়া কোনো অবকাঠামো বা দালান নয়। এটা হওয়ায় ভাসে, ইথারে ভাসে। একারণেই এটার ব্যাপ্তি অনেক বেশি। এটার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠায় কোনো দেশেই সরকার হেল্প করেনা। এগুলো ব্যক্তি উদ্যোগ। সরকার যেটা পারে, আর বাংলাদেশে বিশেষভাবেই যেটা করা খুব জরুরী, সেটা হলো, সেন্সর বোর্ড নামের আজব প্রতিষ্ঠানটাকে শসানে পাঠিয়ে দিতে হবে। গড়তে হবে ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ড। আর ওই বোর্ডে এমন লোকদের স্থান দিতে হবে যারা বাংলা চলচ্চিত্রের প্রসার ও সমৃদ্ধ চান। সফদার ডাক্তার কবিতার মতো সিনেমা পেলেই এটাকে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে ঘায়েল করার অসুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন লোকদের ফিল্ম সার্টিফিকেশন বোর্ডের ত্রিসীমানায় ভিড়তে দেয়া যাবেনা।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৩১ কোটি। যার মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষের হাতে স্মার্টফোন ও পিসি-ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স গেজেট আছে। সহজ কথায় এই ১০ কোটি মানুষই বাংলা কন্টেন্ট সমূহের প্রাথমিক দর্শক। আর ওই কন্টেন্টগুলোতে যদি ইংরেজি, হিন্দি, আরবী, উর্দু, ফরাসী, চাইনিজ ইত্যাদি ভাষায় সাব-টাইটেল সংযুক্ত করা যায় তাহলে বিশ্বজনগোষ্ঠীর হাতে থাকা ২০০ কোটিরও বেশি স্মার্টফোন বা ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের ব্যবহারকারীরা বাংলা কন্টেন্ট দেখার সুযোগ পাবে। তারমানে সম্ভাবনা ব্যাপক কিন্তু আমাদের আয়োজন যখন ভিখেরীর মতো তখন এর সুফল আশা করা বোকামী।
সবশেষে একটা কথা বলে নিচ্ছি। দশ-বিশ কোটি টাকা পুঁজি নিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম খুলে অযথা কেউ টাকা নষ্ট করবেন না প্লিজ। একটা মাঝারি গোছের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম খুলতেও অন্তত এক শ কোটি টাকা দরকার। পাশাপাশি দরকার সঠিক পরিকল্পনা। আর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চালানোর দায়িত্বে নাটকের পরিচালক কিংবা কোনো টিভি চ্যানেলে কাজ করা কেরানী গোছের লোক দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। এক্ষেত্রে যাকে নিতে হবে, তার এই সেক্টরে ব্যাপক অভিজ্ঞতা থাকাটা সবচেয়ে আগে দরকার। ওই ধরনের অভিজ্ঞ লোকের প্রতি মাসে বেতনই হবে অন্তত দশ লাখ টাকা। এবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছি সবার প্রতি – আমরা কি আসলেই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সঠিক পদ্ধতি মেনে চালু করছি?
সূত্রঃ সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী’র ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত।