শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৪ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম
নন্দিত গীতিকবি মিলন খানের আজ শুভ জন্মদিন ভালোবাসি তোমায় সিনেমার ক্যামেরা ক্লোজ চৌদ্দগ্রাম প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন তৌহিদ সভাপতি, সম্পাদক সোহাগ, সাংগঠনিক ফারুক গানের হাট অডিও স্টুডিও এর শুভ উদ্বোধন হলো চলচ্চিত্রে অনুদানের অজুহাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের হরিলুট: সালাহ্ উদ্দিন শোয়েব চৌধুরী গান বাজনা সম্পর্কে কিছু কথা প্রসঙ্গ শুভ্র দেবের একুশে পদকঃ ফরিদুল আলম ফরিদ শেখ কামাল হোসেন এর কথা ও সুরে, চম্পা বণিক এর গাওয়া ‘একুশ মানে’ শিরোনামের গানটি আজ রিলিজ হলো নোয়াখালীতে প্রসূতিসহ নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিকের মামলা, তদন্তে পিবিআই ‘দম’ সিনেমা নিয়ে ফিরছেন পরিচালক রেদওয়ান রনি

হালিম-এর হামলা: মীর শাহনেওয়াজ

মীর শাহনেওয়াজ
  • প্রকাশ সময়ঃ সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৩
  • ৫৬ বার পড়া হয়েছে
মিলিটারি খাবার বা সৈনিকদের খাবার হতে গেলে কিছু শর্ত পূরণ করতেই হয়। মিলিটারি খাবারের বিশেষত্ব হচ্ছে পরিমাণ কম, কিন্তু ক্যালোরি বেশি। আর খুব সাধারণ রেসিপিতে রান্না করে কম সময়ে খেয়ে নেয়া যাবে এমন কিছু। আজ এরকম একটি মিলিটারি খাবার নিয়ে কথা বলতে এলাম।
আজকের খাবারটির নাম হচ্ছে “হালিম”। মামা’র হালিম বলতে পারেন, আবার আমার হালিমও বলতে পারেন। দুই টুকরো মাংসের লোভে, টুকরো দুটো খুঁজতে গিয়ে এক বাটি ডাল সাবাড় করে দেয়ার নাম হলো “হালিম”। যা কিনা মূলতঃ একটা আরব দেশীয় মিলিটারি খাবার।
হালিমে থাকে ছোট ছোট মাংসের টুকরো। আর থাকে মাটির হাঁড়িতে টলটলে বাদামি-হলুদ সুঘ্রাণময় ঘন নদীর ছলকে ওঠা ঢেউয়ের প্রান্তে অমৃতের স্বর্ণালী ছটা। মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে থাকে মাংসল দ্বীপভূমি। দর্শনেই মাত! সুঘ্রাণ গ্রহণেই কুপোকাত!! হালিম নামের এই অমৃত খেতে নেই, গ্রহণ করতে হয়। হালিম ভর্তি হাঁড়ির কানায় নাকে টেনে প্রথমে তার সুঘ্রাণে আচ্ছন্ন হতে হয়। ডাল-চাল-মাংস-মশলা মিলেমিশে যে ঐশ্বর্য্য সৃষ্টি হয়, তা প্রকৃতই দেবভোগ্য। তারিয়ে তারিয়ে থকথকে তরল এই অমৃতের সমুদ্রের গহীনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না কারো।
কাবাব, বিরিয়ানি এবং অন্যান্য মোগলাই খাবারের মতো হালিমেরও উৎপত্তি হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে। রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে মধ্যপ্রাচ্যের “হারিস” নামক এক ধরণের ডাল ও মাংসের মিশ্রণ জাতীয় খাবার থেকে উৎপত্তি হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের “হালিম” খাবারটির। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে হারিস হচ্ছে উপাদেয় একটি খাবার আইটেম। সিরিয়া ও লেবাননে বহুযুগ আগে থেকে খ্রিস্টানরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে হারিস রান্না করতেন অনেকটা বাংলাদেশে লাইলাতুল বরাতে “হালুয়া-রুটি” তৈরির মতো। শুধু তাই নয় লেবাননে জন্ম নেওয়া লন্ডনপ্রবাসী প্রখ্যাত রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউ তার Lebanese Cuisine, লেবানিজ কুইজিন (১৯৯৪) বইয়ে লিখেছেন, স্পেনের ইহুদিরা তাদের সপ্তাহের পবিত্র দিন শনিবারে হারিস রান্না করতেন। এ দেশগুলোতে গরীবদের একসাথে খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিস রান্না করা হতো এখনকার দিনে আমাদের দেশের কাঙ্গালী ভোজের খিচুড়ির মতো করে।
হালিম যদিও আরব দেশীয় পপুলার ডিস, কিন্তু ধীরে ধীরে সেন্ট্রাল এশিয়া হয়ে ভারতবর্ষে এর প্রবেশ ঘটে। বিশেষ করে হায়দ্রাবাদ, দিল্লী, লখনৌ আর কোলকাতায় এর প্রসার ঘটে ব্যাপক আকারে। এই আইটেম বাংলাদেশ আর পাকিস্তানেও এখন সমান জনপ্রিয়।
তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তানে এর নাম “কেসকেক”। আরব অঞ্চলে বলে “হারিস” বা “জারিস”। আর্মেনীয়াতে একে বলে “হারিসা”। আর ভারত, বাংলাদেশে এর নাম “হালিম”। ২০১১ সালে, ইউনেস্কো কর্তৃক “কেসকেক”-কে তুরস্কের একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের হালিম আছে। নাম ভিন্ন, কিন্তু রান্নার প্রক্রিয়া প্রায় এক। এগুলো হচ্ছে গিয়ে হালিম-এরই মাসতুতো ভাই। ইরান, পাকিস্তান বা উত্তর ভারতের কিছু এলাকায় ‘খীচড়া’ নামে যা দেখতে পাবেন তা চানার ডালের সাথে মাংসের মিশ্রণ। পাকিস্তানে যদিও হালিম বা খীচড়া সারা বছর স্ট্রীট ফুড হিসেবে বিক্রি হয়। এই খীচড়া আর হালিমের রেসিপি একই। খীচড়া-তে মাংসের টুকরো আস্ত রাখা হয়, স্রেড করা বা ছাড়ানো হয় না। আবার পূর্ব আর উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ভুট্টোর দানার সাথে মাংসের মিশ্রণ হিসেবে যা দেখবেন তা হচ্ছে ‘উগালী’।
ভারতের হায়দ্রাবাদের হালিমে মূল বস্তু গম আর মাংস। উত্তর ভারতে চানার ডালের সাথে বার্লি আর মাংস দিয়েও হালিম বানানো হয়। লখনৌ, কোলকাতা বাংলাদেশের হালিমে চাল এবং বিভিন্ন প্রকারের ডাল আর মাংস দেওয়া হয়। স্ট্রীট ফুড হিসাবে হালিমের চল বাংলাদেশে সারা বছর জুড়ে, রাস্তার ধারে ভ্যানে বা রেস্টুরেন্টে বিকাল-সন্ধ্যা হলেই হালিমের দেখা পাওয়া যায়। ব্রান্ড হিসাবে বাংলাদেশে ‘মামা হালিম’ বিগত চার দশকের উপরে ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে পবিত্র রমজান মাসে ইফতারের মেন্যু হিসাবে এটির চাহিদা ব্যাপক আকার ধারণ করে। মহররম উপলক্ষ্যেও বাড়িতে বাড়িতে হালিম তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে হালিমের প্রচলন থাকলেও রান্নার কাঁচামালের তফাতে স্বাদে একটু উনিশ-বিশ হয়ে যায়।
তবে ভেতো বাঙালি ভাতের সাথে খাওয়ার উপযোগী হালিমের একটা দেশীয় সংস্করণ উদ্ভাবন করে ছেড়েছে যেটা টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায় “ম্যান্দা” বা “পিঠালি” নামে জনপ্রিয়। রন্ধনপ্রণালী অনেকটা হালিমের মতো হলেও ম্যান্দায় ডালের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় চালের গুঁড়ো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কলার পাতা বিছিয়ে সকলে একত্রে ম্যান্দা-ভাত খাওয়ার সংস্কৃতি এই অঞ্চলে বেশ পুরনো।
ভাত দিয়ে হালিম খাওয়ার মতো মজা, আর কিছুতেই পাবেন না। মুড়ি দিয়েও খেতে পারেন। আবার পরোটা-নান-তন্দুরি-রুমালি রুটি দিয়ে খাওয়ার কালচারটা আছে সিলেটে। অনেক দিন থেকেই নাকি ওখানে প্রচলিত। তবে বাখরখানি’র মাখন-নরম বেহতারিন ছোঁয়ায় ইফতারে হালিম এনে দেয় স্বর্গীয় স্পর্শ। আরেকটা হচ্ছে ফুচকায় পুরের বদলে হালিম ঢেলে খাওয়া। পাকিস্তানে হালিম খাওয়া হয় খাঁটি ঘিয়ে চোবানো নান সহযোগে।
》》হালিম এর টাইম লাইন
সপ্তম শতাব্দীর আগে কোথাও হালিম রান্না করার প্রচলন খুঁজে পেলাম না, এবং সেটা ইরাক থেকে। কিন্তু ভারতবর্ষে হালিমের প্রবেশ সময় হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীটাকেই নির্ভরযোগ্য সময় বলে মনে করা যেতে পারে।
》সপ্তম শতাব্দী
কথিত আছে হালিম রান্নার প্রচলন ইরাক থেকে। মুহাররাম মাসের দশ তারিখে কারবালায় প্রিয় নবী হযরত মহম্মদ (সাঃ)-এর নাতি ইমাম হযরত হোসেনের শহীদ হয়ে যাওয়ার পরে যখন কুফার সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে তখন স্থানীয় উপজাতীয় লোকজন শহীদদের কবরস্থ করে নিজেরা খাবে বলে বিভিন্ন রকম ডাল আর মাংস মিলেয়ে “হারিস” এর মতো একটা খাবার তৈরী করে। তখন থেকেই এই হারিস-এর প্রচলন শুরু। কেউ কেউ মনে করেন, ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্যের রাজা খুসরো’র সময় থেকেই হালিম চলে এসেছে। সপ্তম শতকে মুসলমানরা যখন পারস্য আক্রমণ করে, তখন তারা এই জনপ্রিয় খাবার আইটেমটি সম্পর্কে জানতে পারে।
》নবম শতাব্দী
তবে খাদ্য ইতিহাসের হিসাব ধরলে প্রাচীন গ্রীক সেনাবাহিনীর “পট্যাজ স্যুপ” (Potage Soup) কে হালিমের ‘মাদার’ হিসেবে গণ্য করা যায়, যা কিনা হালিম এবং চটপটির মাঝামাঝি একটা খাবার। আধুনিক কুলিনারির জনক অগাস্টা এস্কোফার-এর Le Guide Culinaire, লা গাইডে কুলিনেয়্যার বইতে শাকাহারি আর মাষাহারি দুই পদ্ধতিতেই এই পট্যাজ স্যুপের বর্ণনা দেয়া আছে।
》দশম শতাব্দী
হারিস-এর উল্লেখ পাওয়া যায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত রেসিপি দশম শতাব্দীর দিকে বাগদাদে ইবনে সায়ার আল ওয়ারাক্ব এর লেখা “কিতাব আল তাবিখ” (The book of recipes) নামের রান্নার বইতে। এই বইটিতে সংকলন করা হয়েছিল তৎকালীন রাজা বাদশাহদের খাবার টেবিলের উপাদেয় বেশ কিছু খাবারের রন্ধনপ্রণালী। সেখানে “হারিস” নামে এই খাবারের কথা উল্লেখ করা আছে। ইবন বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও পারস্যে ডাল, ঘি এবং মাংস দিয়ে রান্না করা হারিস-এর কথা উল্লেখ করা আছে।
》ষোড়শ শতাব্দী
অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ভারতে হারিস-এর আগমন মুঘলদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে ভারতে হারিস-এর আগমন হলেও হারিস ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় হুমায়ুনের পুত্র সম্রাট জালাউদ্দিন আকবরের আমলে। সম্রাট হুমায়ুনের সাথে পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাই বলা যায় পারস্য হয়েই হারিস ভারতে এসেছিল। তা ছাড়া ভারতে আরব বণিক ও ইসলাম প্রচারকদের আগমন সেই হযরত মহম্মদ (সাঃ)-এর সময় থেকেই। তাই আরবদের হাত ধরে যে ভারতে হারিস এসেছিল, সে কথাও অস্বীকার করা যায় না আকবরের শাসন আমলে আবুল ফজলের লেখা “আইন-ই-আকবরি” গ্রন্থে পাওয়া যায় এই হারিস-এর কথা। আকবরের দরবারেও এই সুখাদ্যটি পরিবেশিত হতো।
》ঊনবিংশ শতাব্দী
চাভুস (Chavuse) হল ভারতের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে গুজরাট, কাথিয়াওয়ার এবং কচ্ছ রাজ্যে বসবাসকারী হাধরামি আরব বংশোদ্ভূত মুসলিম সম্প্রদায়। তারা উল্লেখিত অঞ্চলে বিভিন্ন শাসকের অধীনে দেহরক্ষীর চাকরি করতো। চৌশ (Chaush) নামেও পরিচিত এই আরব দেহরক্ষীদের উপর প্রাক্তন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের ৬ষ্ঠ নিজাম, নিজাম মাহবুব আলী খানের (১৮৬৬ – ১৯১১) নিরঙ্কুশ আস্থা ছিল তাই, তিনি তার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে এদেরকে ইয়েমেন থেকে নিয়ে এসেছিলেন নিরাপত্তা রক্ষী এবং দেহরক্ষী হিসাবে নিজাম প্যালেসকে গার্ড দেওয়ার জন্য। তুরস্কের ‘Chiaus’ নামের এক এলাকার খুন-খারাবীপ্রিয় এই চৌশ (Chaush) নামের আদি বাসিন্দারা প্রভুভক্তি আর যুদ্ধবাজ মানসিকতার জন্য সারা বিশ্বে বিখ্যাত। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে তাই ইতিহাসে এদের সুনাম আছে। বলকানদের অটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই এই যোদ্ধারা তুরস্কের রাজপ্রাসাদ পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এই চৌশদের সাথে তাদের মারফা সঙ্গীত এবং নৃত্য আর হারিস নামের খাবার এসে পৌঁছায় হায়দ্রাবাদে। এই হারিসই আমাদের কাছে এখন হালিম নামে পরিচিত।
ভারতে হালিমের জনপ্রিয়তার পেছনে হায়দরাবাদী হালিমের অবদান প্রচুর। তবে বিংশ শতাব্দীতে হালিম জনপ্রিয়করণে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন যে ব্যক্তিটি তিনি হলেন ‘হায়দ্রামাউত’ (বর্তমান ইয়েমেন)-এর শাসক সুলতান সাইফ নাওয়াজ জং বাহাদুর। তিনি ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামদের দরবারের খানদানি আমির ওমরাহ্‌দের একজন। নিজামের বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে জং বাহাদুরও থাকতেন, যেখানে খাদ্য তালিকায় নিয়মিত স্থান পেত তার মাতৃভূমি ইয়েমেনের হারিস। জং বাহাদুরের হাত ধরে ভারতীয় মশলার ছোঁয়া পেয়ে হারিস পরিণত হয়েছে আজকের হালিম-এ।
হারিস বা জারিস পুরনো হায়দ্রাবাদের বারকাস (ব্যারাক, সেনা ছাউনি) এলাকায় খুব জনপ্রিয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে বারকাস এলাকাটা হায়দ্রাবাদের নিজামের আরব দেশীয় নিরাপত্তা রক্ষী এবং দেহরক্ষীদের মিলিটারী ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই হারিস কালক্রমে হালিম নামে লােকমুখে প্রচলিত হতে থাকে। পরবর্তীতে হায়দ্রাবাদীরা নিজেদের স্বাদ আর সামগ্রী অনুযায়ী হালিমের রেসিপি আর টেস্ট বদলে নিয়েছে। তাতে লেগেছে নিজামের বনেদীয়ানা। সিকিউরিটি গার্ডের খাবার হয়ে উঠেছে রয়্যাল কোর্টের শাহী খানা। নিজামদের যুগ অবসান হওয়ার পর পঞ্চাশ-এর দশকে হায়দরাবাদে ইরানি হোটেলগুলোতে হালিম বিক্রি করা শুরু হয়।
তবে যাদের হাত ধরেই আসুক, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হালিম সমান জনপ্রিয়। আর মধ্যপ্রাচ্যের হারিস-এর সাথে ভারতের হালিমের মূল পার্থক্যটাই হল মশলার ব্যবহারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য খাবারগুলোর মতোই হারিস-এ মশলা ব্যবহার করা হতো কম। কিন্তু ভারতে মশলার সমারোহে হালিমও বেশ মশলাদার।
.
এবার জানা যাক হারিস-এর ভারতীয় নাম হালিম কেন হলো? এই প্রশ্নের বিপরীতে প্রচুর উত্তর পাওয়া যায়।আরবীতে ‘হালিম’ মানে ধৈর্য্যশীল, যাকে কিনা ধীরস্থিরও বলা যায়। আসলেই তো ‘স্লো কুক ডিশ’ হালিম রান্না করতে দরকার সময় ও ধৈর্য্যের। হালিম রান্না করতে ঢিমে আঁচে ৮-৯ ঘন্টা রান্না করতে হয়।হয়তো সেখান থেকেই হারিস-এর ভারতীয় সংস্করণের নাম হালিম হয়েছে। তবে এই তথ্য নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। এখানেই শেষ নয়। ঢাকার উত্তরায় একটি রেষ্টুরেন্টে এখন সুস্বাদু এই হালিম বিক্রি হচ্ছে “ডালিম” নামে। মূলত আপত্তিটা হলো আল্লাহর ৯৯ মহান নামের একটা নাম ‘আল-হালিম’ (الحليم), যার অর্থ ‘ধৈর্য্যশীল’ আর তাই আল্লাহর নামে খাবারের নাম হতে পারে না। যেহেতু ডাল দিয়ে বানানো তাই বিকল্প নাম ‘ডালিম’ দেওয়া হয়েছে। যদিও উর্দূতে ডাল না বলে দাল বলা হয়। তখন আর ডালিম থাকছে না, হয়ে যাবে দালিম। যা দাল দিয়া বানানো হয় তাকে উর্দূতে ‘দালচা’ বা ‘দালিয়া’ও বলে। এগুলো হলো পাকিস্তানী শিয়া, সুন্নী, সৌদি আরবের ওয়াহাবী আর কট্টর সালাফীদের অনুসারী মৌলভী সাবদের ‘আমার মতই শ্রেষ্ঠ’ এটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা।
.
হালিম রান্নার রেসিপিঃ
》যা যা লাগবে
1½ কাপ আধভাঙা গম,
½ কাপ ছোলার ডাল,
¼ কাপ তুর ডাল (অড়হর),
¼ কাপ মুগ ডাল,
¼ কাপ মুসুরি ডাল,
¼ কাপ মটর ডাল,
¼ কাপ কলায়ের ডাল,
¼ কাপ গোবিন্দভোগ চাল,
৩ চামচ তেল,
পরিমাণমতো লবণ, হলুদ।
১ কেজি গরু বা খাসির মাংস (হাড় আর চর্বি বাদে),
২ টি পেঁয়াজ কুচি,
২ চামচ আদা রসুনের পেস্ট,
১ চামচ হলুদের গুঁড়ো
৫ চামচ তেল,
৩ চামচ হালিম মসলা গুঁড়ো,
পরিমাণমতো লবণ।
.
》যেভাবে হালিম রান্না করবেন
প্রথমে ছোলার ডাল, আর আধভাঙা গম ঘন্টা দুয়েক ভিজিয়ে নিন। তারপর এর সাথে বাকি সব ডাল আর চাল, কুকারে ৩ চামচ তেল আর ১ চামচ লবণ দিয়ে সেদ্ধ করুন। দেখবেন যেন একদম মিহি না হয়ে যায়। একটু দানা দানা থাকতে হবে।
এবার কুকারে ৫ চামচ তেল দিন। দুটো পেঁয়াজ কুচি আর মাংস দিয়ে ভাজুন। পানি ছেড়ে এলে আদা রসুনের পেস্ট দিয়ে কষতে থাকুন। এবারে ওই ৩ চামচ হালিম মসলা দিয়ে দিন। ১ চামচ হলুদের গুঁড়ো দিন। মিনিট পাঁচেক কষে পানি দিন। হাই ফ্লেমে কুক করুন। সেদ্দ হয়ে এলে মাংসটা তুলে এনে একটা পাত্রে দুটো ফর্ক বা হাত দিয়ে ছাড়িয়ে নিন। মাংসের ফাইবারগুলো যেন আস্ত থাকে, কিমার মতো মিহি হয়ে যায় না যেন।
বড় একটা পাত্রে ঘি গরম করে ভালোভাবে সেদ্ধ করে নেওয়া ডাল, চাল ও গম দিয়ে দিন। ছাড়ানো মাংস দিয়ে ভালো করে মিক্স করুন। মাংসের বাকি ঝোলটাও দিয়ে দিন। এবারে দুকাপ গরম পানি দিন। ফুটতে থাকলে আঁচ কম করে ঢাকা দিয়ে দিন। মাঝে মধ্যে দেখে নেবেন যেন পাত্রের নীচে ধরে না যায়। দরকার হলে পানি দিন। এইভাবে ৮-৯ ঘণ্টা ধরে নাড়তে পারলে ভালো হয়। যত ফোটাবেন তত মাংস আর ডালের মিশ্রণের টেক্সচার ভালো হবে।
নামিয়ে সার্ভ করার আগে ফোড়ন বা বাগাড় দিতে হবে। ঘি গরম করে তাতে পেঁয়াজ কুচি আর আদা কুচি বাদামী করে ভেজে মিশ্রণের উপরে ছড়িয়ে দিন। আরো উপাদেয় করার জন্য পাতি লেবু, লেবুর রস, পুদিনা পাতা, কাঁচা মরিচ, টম্যাটো, ধনে পাতা কুচি এবং ভাজা পেঁয়াজের চুর বা বেরেস্তা আর ঘি দিয়ে গার্নিস করে নিন।
তৈরি হয়ে গেলো সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হালিমঃ
সরল স্বীকারোক্তিঃ যেসব সূত্রে প্রাপ্ত ছবি ও লেখা বা যাদের লেখা নিয়ে এ পোষ্টটি তৈরি করা হয়েছে।
বই: ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি, অলোক নাথ শেঠ, Bivas Roy Choudhury, Hassan Mahadhi, ভউইকিপিডিয়া

দয়া করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
April 2024
S M T W T F S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031