আমরা জানি যে গান কায়িক পরিশ্রমের একঘেয়েমি দূর করে ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি করে। এজন্য আমাদের মাঝিমাল্লারা ভাটিয়ালি গান, সারি গান করেন; গাড়োয়ানরা ভাওয়াইয়া গান করেন। আরবের বা রাজস্থানের মরুভূমির উটের রাখালরাও ‘হুদি গান’ নামে একপ্রকার গান করে থাকেন।
.
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, একবার রসুলাল্লাহ কোনো এক সফরে যাচ্ছিলেন। জনৈক উট চালক উটের রশি ধরে হেঁটে যাচ্ছিল আর ‘হুদি’ গান গাচ্ছিল, আর উটগুলোকে আরো জোরে চলার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। উটের পিঠে আরোহী ছিলেন রসুলাল্লাহর স্ত্রীগণ। স্ত্রীগণের উটটি রসুলাল্লাহর উটকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। তখন তিনি গায়ককে লক্ষ্য করে বললেন, আনযাশাহ! সাবধানে চলো; এই কাচের পাত্রদের সঙ্গে কোমল আচরণ করো। (মুসনাদে আহমদ, ৩:১৭২, ১৮৭, ২০২)। তিনি রসিকতার ছলে নারীদের যেন কষ্ট নয় হয় সেজন্য উট আস্তে চালাতে বললেন, কিন্তু বললেন না যে, গান গেয়ো না। গান হারাম।
.
রসুলাল্লাহ যখন হেজরত করে মদিনায় এসে পৌঁছান তখন তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আনসার নারী পুরুষ শিশু কিশোর নির্বিশেষে দফ বাজিয়ে “তালা-আল বাদরু আলাইনা – ‘সানইয়াতুল বিদা’ হতে আমাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকবে, আমাদের ওপর ওয়াজিব তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা।” গানটি গাইতে থাকেন। গানটি আজও মিলাদে গাওয়া হয়।
.
আমাদের দেশের শ্রমিকরা কাজের তালে তালে শ্রম লাঘব করার “হেইয়ো হো- হেইয়ো হো” ইত্যাদি ধ্বনি ব্যবহার করে একপ্রকার শ্রমসঙ্গীত করে থাকেন। আরবে এই সঙ্গীতকে বলে রাজস্। মদিনায় এসে মসজিদে নববী নির্মাণের সময় আল্লাহর রসুল (সা.) স্বয়ং এই শ্রমসঙ্গীত গেয়েছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও গান গেয়েছিলেন। আনাস (রা.) বলেন, রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিগণ মসজিদ নির্মাণের সময় খেজুর গাছগুলোকে কেবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে স্থাপন করলেন। চৌকাঠের দুই বাহুতে স্থাপন করলেন পাথর। রসুলাল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা তখন ‘রাজস্’ তথা কর্মসঙ্গীত গাচ্ছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, হে আল্লাহ! আখেরাতের মঙ্গলই প্রকৃত মঙ্গল। আপনি সাহায্য করুন আনসার ও মোহাজিরদের। -(বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ।)
.
খন্দকের যুদ্ধের সময় হযরত সালমান ফারসির পরামর্শে সাহাবীদের নিয়ে মদীনাকে কোরাইশদের হামলার হাত থেকে রক্ষা করতে রসুল (সা.) যখন মদীনার তিন দিকে খন্দক (গর্ত) করছিলেন তখন সবাই সমস্বরে গান গাইতে গাইতে খনন কাজ করছিলেন। সুতরাং সৎকাজের উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য গান গাওয়াকে রসুলাল্লাহর সুন্নাহ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
.
বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে খন্দক যুদ্ধের দিন দেখেছি, তিনি স্বয়ং মাটি বহন করেছেন। এমনকি তাঁর সমগ্র বক্ষদেশের কেশরাজিকে মাটি আবৃত করে ফেলেছে আর তাঁর শরীরে অনেক পশম ছিল। তখন তিনি আবদুল্লাহ ইবনু রাওহায়া (রাঃ) রচিত কবিতা অবৃত্তি করছিলেন:
.
‘হে আল্লাহ আপনি যদি আমাদেরকে পথ না দেখাতেন, তাহলে আমরা পথ পেতাম না। আর আমরা সাদকা করতাম না এবং সালাত আদায় করতাম না। আপনি আদের প্রতি প্রশান্তি অবতীর্ণ করুন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদেরকে অবিচল রাখুন। শত্রুগণ আমাদের উপর অত্যাচার চালিয়েছে, যখন তারা ফিৎনা সৃষ্টির সংকল্প করেছে, আমরা তা অস্বীকার করেছি।’ আর তিনি এ কবিতাগুলো অবৃত্তিকালে স্বর উঁচু করেছিলেন।
.
মনে রাখতে হবে, আল্লাহ সুর পছন্দ করেন, তাই কোর’আন সুর করে তেলাওয়াত করতে উৎসাহিত করা হয়, সুর করে আযান দেওয়া হয়। তেমনি সুর করে কবিতা আবৃত্তিও ছিল আরবের সংস্কৃতির অন্যতম অনুসঙ্গ।