এ তিন বলয়ের বাইরে কয়েকটি উপবলয় দলের ভেতরে নানাভাবে সক্রিয় আছে বলে জানান বিএনপির নেতারা। জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের শামীম, মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহরিয়ার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুজ্জামান সেলিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী ও সহসভাপতি ফরহাদ চৌধুরী শামীম এই উপবলয়ের নেতৃত্বে আছেন বলে জানা গেছে।
স্বেচ্ছাসেবক দলের নতুন জেলা ও মহানগর কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ তুলে বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক সামসুজ্জামান গত ১৮ আগস্ট দল ছাড়ার ঘোষণা দেন। এতে দলের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়। সামসুজ্জামানের ঘোষণার পর তাঁর অনুসারী বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের প্রায় তিন শ পদধারী নেতা কয়েক দিনের ব্যবধানে পদত্যাগ করেন।
২০১৮ সালে ছাত্রদল এবং ২০১৯ সালে যুবদলের সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি গঠনের সময়ও ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতাদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ উঠেছিল। ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার পরদিন ৯ জন নেতা পদত্যাগ করেন। এর জের ধরে ওই বছরের ৩০ জুলাই ফয়জুর রহমান ওরফে রাজু নামের এক ছাত্রদল নেতা প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন।
নেতা-কর্মীরা জানান, সাইফুর রহমান ও ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতি, বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মুবিন চৌধুরীর রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো—সব মিলিয়র স্থানীয় বিএনপির নেতৃত্ব অনেকটা মুক্তাদিরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এখন দলের বিভিন্ন কমিটিতে থাকা নেতাদের অন্তত ৭০ ভাগ তাঁর অনুসারী। তবে অপেক্ষাকৃত প্রবীণেরা মুক্তাদিরকে মেনে নিতে পারেননি বলে জানান তরুণ নেতারা।
জানতে চাইলে সামসুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন দলের আদর্শিক কর্মীদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। ছাত্রদল ও যুবদলের যোগ্য নেতাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। তিনি বলেন, ‘দলের স্বার্থে আমরা যেসব কথা বলছি, তা শোনা হচ্ছে না। এই দলের পেছনে আমার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। অথচ আমিই অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছি।’
সামসুজ্জামানসহ তিন শতাধিক নেতা–কর্মীর পদত্যাগ কিংবা বলয়ভিত্তিক রাজনীতিতে নেতৃত্বদানকারী কোনো নেতা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি। এঁদের মধ্যে আরিফুল হক চৌধুরী শুধু বললেন, ‘আমি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় আছি, থাকব। তবে স্থানীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না।’
সব পক্ষের অভিযোগের আঙুল যে আবদুল মুক্তাদিরের দিকে, সেই তিনিও স্থানীয় বিভেদের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ। এর বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বে থাকা বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান বলেন, ‘দলের দুর্দিনের সঙ্গী সামসুজ্জামান। দলের মহাসচিব তাঁর ক্ষোভের বিষয়টি লিখিতভাবে জানাতে বলেছেন। বিষয়টি অবশ্যই সমাধানের চেষ্টা করা হবে। কারণ, জামানের মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষ দলে প্রয়োজন।’
নেতা–কর্মীরা জানান, মহানগর বিএনপির এই কমিটি গঠনের পর অনেক নেতা প্রবাসে চলে যান। কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুজ্জামান সেলিম দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই যুক্তরাজ্যে চলে যান। প্রথম যুগ্ম সম্পাদক আজমল সাদেক এবং দ্বিতীয় যুগ্ম সম্পাদক শামীম সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। আবার যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে তৃতীয় যুগ্ম সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। ২৩৩ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির অন্তত ২০ জন প্রবাসে আছেন বলে দলের নেতারা জানান।
মহানগর কমিটি গঠনের দিন জেলা কমিটিও গঠিত হয়েছিল। মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি কামরুল হুদা জায়গীরদারকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন মাসের মধ্যে তাঁদের সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তাঁরা তা করেননি।
গত বছরের ৩ মার্চ জেলার আহ্বায়ক কমিটির ৯ জন সদস্য সংবাদ সম্মেলন করে আহ্বায়কের বিরুদ্ধে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ আনেন। একইভাবে বিভিন্ন শাখা কমিটির নেতৃত্বে থাকা ও বাদ পড়া নেতাদের একটি অংশও আহ্বায়কের বিরুদ্ধে সরব হন। কামরুল হুদা জায়গীরদার বলেন, কমিটি গঠনে কোনো স্বেচ্ছাচারিতা ছিল না। কিছুটা ভুল–বোঝাবুঝি ছিল। তবে দলকে এগিয়ে নিতে সবাই এখন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন।
এ বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান বলেন, ‘সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে জেলা কমিটিও করা হবে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভাজন দূর করে আমরা দলকে এগিয়ে নিতে চাই।’