বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থেকেও অর্থ-সম্পদ, বাড়ী-গাড়ী, দালান-কোটা, জমি-পুকুর, সুখ-বিলাশের লোভ সামলিয়ে সাধারণ মানুষের ভালবাসা আর সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে চলেন, এখনও এরকম নজির আছে তা হয়তো কারো বিশ্বাসই হবে না। স্বাধীনতার পরে এ দেশে এমপি হয়ে একটা বাড়ির মালিক হতে পারেননি, বোধ করি তার সংখ্যা একবারেই নগন্য। এরকম একজন মানুষ বাংলাদেশেই আছেন। তাদেরই একজন রাজবাড়ী জেলার পাংশার আব্দুল মতিন মিয়া । যিনি জাসদের মতিন নামে পরিচিত। দোর্দন্ড প্রতাপে এ নেতার ইশারায় একসময় বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খেত। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে তিনি আস্থা ও বিশ্বাসে ঘরের ছেলে হিসেবে পরিচিত।
তার পুরো নাম আব্দুল মতিন মিয়া। মুক্তিযুদ্ধ’র শুরুতেই রাজবাড়ী থেকে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে পাংশার মাছপাড়া নিজের এলাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেছিলেন। একাত্তরের মার্চেই প্রথম পাকহানাদার মুক্ত করতে কুষ্টিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে ভারতের প্যারাগুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে এলাকার মানুষের পাশে দাড়ান। পাংশা-কালুখালী অঞ্চলে একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গড়ে তোলেন তিনি। একের পর এক অপারেশনের মাধ্যমে তিনি পাকহানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি লড়াইয়ে যোগ দিয়ে নিজের বাহিনীর তিন সদস্য রফিক, শফিক ও সাদি,র রক্তের বিনিময়ে ১৮ই ডিসেম্বর রাজবাড়ী শহর শত্রুমুক্ত করতে মরণপণ ভূমিকা নেন। তিনি পাংশা-কালুখালী মুজিব বাহিনীর কমান্ডার (বিএলএফ) ছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি জাসদের রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৭৯-১৯৮২ সালে তিনি ফরিদপুর-২ (পাংশা-বালিয়াকান্দি) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবারের উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে তিনি পাংশার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিন্তু সাধারণ মানুষের খুব কাছের একজন হয়েও ‘রাজনৈতিক বানিজ্যে’ আব্দুল মতিন মিয়া বড্ড বেমানান। গ্রামে একটা পাকা বাড়িও করতে পারেন নাই। সেকারণে অনেকেরই আপসোসের সীমা নেই, এমপি-চেয়ারম্যান হয়ে কিছুই করতে পারলেন না মতিন মিয়া । কিন্তু তাতে মতিন মিয়ার কোন আপসোস নেই। তিনি এখনও সাধারণের একজন হয়ে থাকতেই খুশি ও সুখি।
রাজবাড়ীর সাংবাদিক বাবু মল্লিক এক অনুভূতিতে মতিন মিয়া সম্পর্কে বলেছেন, পাংশা রেল স্টেশন বেঞ্চিতে সন্ধ্যায় বসেছিলেন তখন লোডশেডিং। মতিন মিয়ার কন্ঠ শুনে একজন ‘মামা’ বলে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলন, খুব ঘনিষ্ট হয়ে ফিসফিস করে কী যেন বলেই আবার সরে গেলেন। মতিন মিয়া তখন ফোনের লাইটটা জ্বালতে বললেন, সেই আলোতে ডান হাতটা সামনে এগিয়ে ধরে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। দেখি ৫০০ টাকার একটা নোট ! বললেন ‘দেখ ! মামার বকশিস ! আমার কোন অসুবিধা নেই, এরকম ভাগ্নে, ভাস্তে, আত্মীয়-স্বজনকে তো এড়াতে পারিনা। পথে ভ্যানওয়ালারা ভ্যানে তুলে যেখানে যাব জোর করে নিয়ে যাবে, টাকা নিবে না। ধোপা-নাপিতে টাকা নিবে না। আমি জোড় করে কীভাবে ওদেরকে টাকা পয়সা দেব ? বরং এভাবে মামা, কাকা, ভাই- এসব ডাক শুনে শুনেই আমার দিন কেটে যায়। মানুষের ভালবাসার চেয়ে দামি আর কিছুই নাই।’
তিনি আরও বলেন, আব্দুল মতিন মিয়ার ক্ষেত্রে এ বাস্তব চিত্র আমার দেখা বা শুধু তারই মুখের কথা নয়, আপনি যদি পাংশার গ্রামাঞ্চলে গিয়ে একটু কানখাড়া করেন, দেখবেন এটা কোন গল্প নয়।
আব্দুল মতিন মিয়া আর কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেননি। তবে তার স্ত্রীকে সবাই দাড় করান গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়রাম্যান পদে। চেয়ারম্যানের চেয়ে বেশি ও সবোর্চ্চ ভোটে নির্বাচিত হন। এটা মতিন মিয়ার প্রতি মানুষের ভালবাসার নিদর্শন। বর্তমানে তিনি উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মৃগী শহীদ দিয়ানত ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ী জেলার ইতিহাস বইয়ের লেখক মোঃ নজরুল ইসলাম জাহাঙ্গীর আব্দুল মতিন মিয়া সম্পর্কে বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের সিংহ পুরুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরমুক্তিযোদ্ধা সাবেক এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মিয়া। গণমানুষের নেতা ও জনপ্রতিনিধি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চেতনার ক্লান্ত যোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর নীতি বুকে ধারণ করে অনেকদিন পথ চলা। মাঝে কিছুদিনের রাজনৈতিক বিচ্ছেদ। তারপরেও তারমধ্যে তৃপ্তির হাসি দেখি, এ কারণে যে ক্ষমতার দাপটে কখনই সে অবৈধ অর্থ-সম্পদের মালিক হতে যান নাই। সাধারণ বিচারে হয়তো তিনি গরিব কিন্তু নীতির রাজনীতির বাজারে অনেক বড় মহাজন।
এলাকার লোকজন বলেন, আব্দুল মতিন মিয়া, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপরও তার একটি থাকার মতো ঘর নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঘর চুইয়ে পানি পড়ে। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অসহায়, অসচ্ছল ও গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাদের “বীর নিবাস” ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন। কিন্তু একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার ঘর পাবার অধিকার নেই কেন? সে কি ঘর পাওয়ার যোগ্য নয়? আমরা দাবী জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, সাবেক এমপি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গৃহহীন এ ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় একটি বীর নিবাস উপহার দেন।
এফপিআই মেহেদী হাসান বলেন, কি অবাক হলেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য, তিনি অন্য রাষ্ট্রের নন এই বাংলাদেশের। তিনি রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। আব্দুল মতিন মিয়া, সবাই তাকে না চিনলেও বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ রাজনীতিবীদ উনাকে চিনেন। তাঁর আছে আজও সাধারণ জনগনের বুকভরা ভালোবাসা আছে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা সম্মান আছে, সততা স্বচ্ছতা জবাবদিহীতা তুলনা নেই তাঁর। নেই শুধু টাকা, নেই ঘর, নেই মার্কেট, নেই আলীসান বাড়ি। একদম সাধাসিধে ভদ্রচিত ব্যক্তিত্বমনা এ ব্যক্তিটিই ছিলেন রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি। স্যালুট আপনাকে, স্যালুট আপনার সততাকে, আপনি আমাদের গর্ব, অহংকার, আপনি আমাদের শিক্ষাগুরু। এ ভাবেই মন্তব্য করেন।
সাবেক সংসদ ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মিয়া বলেন, আমি মানুষের ভালোবাসার রাজনীতি করেছি। অর্থ-সম্পদ কামানোর রাজনীতি করি নাই। আল্লাহ আমাকে খুব ভালো রেখেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করেই আমি সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে চাই।
সূত্রঃ হিল্লোল মিয়া’র ফেসবুক পোষ্ট থেকে সংগৃহীত