নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের তাগিদের মধ্য দিয়েই শেষ হলো বিএনপির দ্বিতীয় দফা সিরিজ বৈঠক। তিন দিনব্যাপী সিরিজ বৈঠকের শেষদিন বৃহস্পতিবার দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতিরা তাদের মত তুলে ধরেন। এ সময় তারা বলেন, বর্তমান সরকারকে হটাতে আন্দোলনের বিকল্প নেই।
সেই আন্দোলনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সরকারবিরোধী সব দলকে একই প্ল্যাটফরমে আনতে কাজ করতে হবে। তাদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন হতে পারে।
তবে জোট বাড়ানোর ব্যাপারে নানা আপত্তি তুলে ধরে নেতারা বলেন, ‘ওয়ান ম্যান শো’ দলের সঙ্গে জোট করে কোনো লাভ হবে না। বড় দলের সঙ্গে জোট হতে পারে। তবে যারা বিএনপির সভায় এসে আওয়ামী লীগ নেতার গুণকীর্তন করবে তাদের সঙ্গে জোট চাই না। জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেন কেউ কেউ।
তারা আরও বলেন, যা কিছুই করা হোক, রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে বিএনপিকেই। আন্দোলনের জন্য দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রস্তুত আছে। তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে।
তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজধানী ঢাকাকে তৈরি করে বিএনপিকে এককভাবে আন্দোলনের ডাক দিতে হবে। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিকাল পৌনে ৪টায় এ বৈঠক শুরু হয়ে চলে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা। শেষদিন সাংগঠনিক বিভাগ রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের নির্বাহী কমিটির সদস্য, জেলা ও মহানগরের সভাপতিরা অংশ নেন। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর টানা তিন দিন কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত নেন দলের নীতিনির্ধারকরা। এরপর দ্বিতীয় দফায় প্রথম দিন ২১ সেপ্টেম্বর সাংগঠনিক বিভাগ ঢাকা ও ফরিদপুর, দ্বিতীয় দিন ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা সভাপতিদের পরামর্শ নেয় বিএনপি। দুই দফার ধারাবাহিক বৈঠকে ৪৯১ জন অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৩০০ জন বক্তব্য রাখেন।
বৈঠকে লন্ডন থেকে স্কাইপেতে সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মূল মঞ্চে ছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। বৈঠকে ১০৮ নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও উপস্থিত ছিলেন ৮৬ জন। বক্তব্য দেন ৬৫ জন।
বৈঠকে অংশ নেন নজরুল ইসলাম মোল্লা, নাজিম উদ্দীন আলম, হাফিজ ইব্রাহিম, আবুল হোসেন, মেসবাহউদ্দিন ফরহাদ, আলমগীর হোসেন, হাসান মামুন, রফিকুল ইসলাম মাহতাব, হায়দার আলী লেলিন, দুলাল হোসেন, গোলাম নবী আলমগীর, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমতুল্লাহ, এলিজা জামান, মাসুদ অরুণ, শহিদুল ইসলাম, রেজা আহমেদ বাচ্চু মোল্লা, শহীদুজ্জামান বেল্টু, আব্দুল ওয়াহাব, টিএস আইয়ুব, মতিউর রহমান ফরাজি, বিশ্বাস জাহাঙ্গীর আলম, শেখ মজিবুর রহমান, অহিদুজ্জামান দীপু, শফিকুল আলম মনা, মনিরুজ্জামান মনি, কাজী আলাউদ্দিন, ডা. শহীদুল আলম, মীর রবিউল ইসলাম লাভলু, সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, সাবরা নাজমুল মুন্নী, ফরিদা ইয়াসমিন, রাগিব রউফ চৌধুরী, আয়েশা সিদ্দিকা মনি, নার্গিস ইসলাম, মাহবুবুর রহমান হারিছ, লাভলী রহমান, আলী আজগর হেনা, শামসুল আলম প্রামাণিক, একেএম মতিউর রহমান মন্টু, এম আকবর আলী, একেএম সেলিম রেজা হাবিব, সিরাজুল ইসলাম সরদার, আব্দুল মতিন, আবু বকর সিদ্দিক, জয়নাল আবেদীন চান, গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, সিমকী ইমাম খান, জহুরুল ইসলাম বাবু, ফয়সাল আলীম, রমেশ দত্ত, আনোয়ার হোসেন ব্লুু, রোমানা মাহমুদ, শামসুল হক প্রমুখ।
সভার শুরুতে শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। সহযোগিতা করেন দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজুদ্দিন নসু, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মনির হোসেন, বেলাল আহমেদ। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার।
বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সংগঠনের অবস্থা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য কী করা যেতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে গণতন্ত্রের নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তি এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যারা আলোচনা করেছেন তাদের সব বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর পরে আমাদের দলের নীতিনির্ধারণীয় সভায় সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তখন আপনারা জানতে পারবেন আমরা কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করব।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল বলেন, ‘ওয়ান ম্যান শো’ দলগুলোর সঙ্গে জোট করে কোনো লাভ হবে না।
বিএনপিকেই এককভাবে আন্দোলন করে দেশে সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে।’ রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চান বলেন, আন্দোলন করেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আন্দোলনে সফল হতে হলে ঢাকায় তা সফল হতে হবে। খান রবিউল ইসলাম রবি বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট করা চলবে না। তাই অবিলম্বে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। আর দলকে পুনর্গঠন করতে গিয়ে বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নানা ধরনের অবৈধ লেনদেন করছে-এসব দূর করতে হবে। নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হলে একটা হেল্প সেল গঠন করা উচিত। সেখান থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে যারা আহত হন, নিহত হন তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে হবে। কেউ কারাগারে গেলে তাকে সহায়তায় লিগ্যাল এইড কমিটিকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারলেই শেখ হাসিনার পতন আন্দোলন ত্বরান্বিত হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন সফল হবে।
নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের আমাদের প্রতি আস্থা নেই। আন্দোলন করে যারা কারাগারে গেছেন, যারা আহত হয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা দিতে হবে। তাহলে তারা পুনরায় ঝুঁকি নিতে চাইবে। না হলে ভবিষ্যৎ আন্দোলনে তারা রাজপথে নাও নামতে পারে।
এক নেতা বলেন, চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা মারা যাওয়ার পর দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি পাঠানো হয়েছিল। কেন দেওয়া হয়েছে সেটার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
সাবেক সংসদ সদস্য মাসুদ অরুণ বলেন, সারা দেশে আন্দোলনের জন্য স্ফুলিঙ্গের মতো প্রস্তুত। সবাইকে সংগঠিত করে তা কাজে লাগাতে হবে। নির্বাচন কমিশন গঠন প্রসঙ্গে নির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেন, সরকার যাতে দলীয় লোক দিয়ে ইসি গঠন করতে না পারে সেজন্য এখন থেকে আন্দোলন করতে হবে।