ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে আজ শুক্রবার ‘ভারতীয় মিডিয়ায় জুলাই অভ্যুত্থান পরিবেশনার ধরন: একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে আলোচনার আয়োজন করা হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে আজ শুক্রবার ‘ভারতীয় মিডিয়ায় জুলাই অভ্যুত্থান পরিবেশনার ধরন: একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে আলোচনার আয়োজন করা হয়।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তৎকালীন সরকারের ভাষ্য প্রচার করেছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও ভারত সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি সেল ও গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপতথ্য ছড়িয়েছে।
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। ‘ভারতীয় মিডিয়ায় জুলাই অভ্যুত্থান পরিবেশনার ধরন: একটি পর্যালোচনা’ শিরোনামে এই আলোচনার আয়োজন করে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান পর্যালোচনার প্ল্যাটফর্ম ‘জুলাই গণপরিসর’।
অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, প্রাক্–অভ্যুত্থান পর্বে জুলাই মাসে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভাষ্য প্রচার করেছে। শেখ হাসিনা ‘রাজাকার’ বলার পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমের বড় আক্ষেপ ছিল—তরুণ প্রজন্ম ‘রাজাকার’ শব্দটাকে আলিঙ্গন করেছে। তারা এ সত্যটা গোপন করেছে যে শিক্ষার্থীরা শব্দটা ব্যবহার করেছেন প্রতিবাদ হিসেবে।
সারোয়ার তুষার বলেন, ৮ আগস্ট বাংলাদেশকে ‘সম্ভাব্য শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্ট। ভারতীয় গণমাধ্যমের এই ভাষ্য দেশটির সরকারি নীতিরই অংশ। অভ্যুত্থানের পর যে নৈরাজ্য হয়েছে, সেটাকে ‘সেক্যুলার বনাম রিলিজিয়াসদের’ (ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ধর্মপরায়ণ) দ্বন্দ্ব এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থান হিসেবে দেখাতে চেয়েছে তারা। ভারতের স্বার্থের পক্ষে তারা বিষয়গুলো দেখাতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত বয়ান প্রবলভাবে বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে দ্য প্রিন্ট ছাড়া আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) গণমাধ্যম অধ্যয়ন ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় বয়ানে একধরনের ওনারশিপ (মালিকানা) আছে। তাদের গণমাধ্যম সে স্বরটাকেই বিবর্ধিত করছে। অনেক বেশি ইসলামফোবিক (ইসলামবিদ্বেষী) বয়ান তৈরি হচ্ছে। আমাদের বয়ানটা আমাদের তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ইন্ডিয়ান স্টাডিজের মতো বিষয় আছে, সেগুলোও লড়াইয়ের আরেকটা ক্ষেত্র। সে ক্ষেত্রটাতেও আমাদের যেতে হবে এবং লড়াই করতে হবে।’
বাংলাদেশে ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের আগে ও পরে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রচারণাকে মোটাদাগে ‘ডিজইনফরমেটিভ’ (অপতথ্যভিত্তিক) বলে আখ্যা দেন এএফপির ফ্যাক্ট চেকিং এডিটর কদরুদ্দীন শিশির। তিনি বলেন, জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে ভারতীয় গণমাধ্যমের ভাষ্য তাদের দীর্ঘ সময়ের একটি চর্চার চূড়ান্ত রূপ। জুলাইয়ের আগেও বাংলাদেশের বিষয়ে তারা অপতথ্য প্রচার করেছে। ৫ আগস্টের পর ভারত সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি সেল ও গণমাধ্যম বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা অপতথ্য ছড়িয়েছে। আন্দোলনের সঙ্গে ইসলামপন্থী, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কিত ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করেছে তারা।
ভারতরাষ্ট্র, আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় গণমাধ্যমকে একই স্বরে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা পাল্টা ফ্লো অব ইনফরমেশন (তথ্যের প্রবাহ) তৈরি করতে হবে। প্রতিটি ব্যাপারে একটা পাল্টা বয়ান তৈরি করতে হবে, যেটা বাংলাদেশি বয়ান। আমাদের যে বয়ানটি খাওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তার বিপরীতে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘ভারতের সফট পাওয়ারকে (যাঁরা জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখেন) আমরা যেন আন্ডারমাইন (অবমূল্যায়ন) না করি। তাঁদের বয়ানগুলো গ্লোবাল ট্র্যাকশন পাচ্ছে (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করছে)। ভারত তার ন্যারেটিভ (বয়ান) তৈরি করছে। আমরা একটা ঝুঁকির মধ্যে আছি। ভারতের সুশীল সমাজ ও জনগণের সঙ্গে আমাদের সংযোগ বাড়াতে হবে। আমাদের ন্যারেটিভ তাদের কাছে পৌঁছায়নি। আমাদের তথ্যগুলো সব জায়গায় পৌঁছাতে হবে।’
এ সময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাভিন মুর্শিদ বলেন, জুলাই বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহের ক্ষেত্রে ভারতীয় গণমাধ্যম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। গণমাধ্যমের বর্ণনা দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।