এমন ঘটনা সিনেমার ইতিহাসে আগে ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। একসঙ্গে ২৪টি সিনেমার চিত্রনাট্য, যার মধ্যে ২২টিই ব্লকবাস্টার হিট। তাঁদের সম্পর্কেই এমন কথা বলা যায়। তাই জোয়া আখতারের কথাটা মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়। হিন্দি সিনেমার খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, এতক্ষণে বুঝে গেছেন হচ্ছিল আলোচিত চিত্রনাট্যকার জুটি সেলিম-জাভেদের কথা। তাঁদের অবসরের পর কত বছর পেরিয়ে গেছে, তবু এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক সেলিম খান ও জাভেদ আখতার। হিন্দি সিনেমাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন এ দুজন। আজকাল লেখকদের পারিশ্রমিক নিয়ে কত কথা হয়, অথচ চার-পাঁচ দশক আগে তাঁরা নায়কের চেয়েও বেশি পারিশ্রমিক নিতেন; এ কথা এখন অবিশ্বাস্যই মনে হয়। হিন্দি সিনেমায় বহুল চর্চিত ‘অ্যাংরি ইয়ংমেন’ ধারণা তৈরি হয় সেলিম-জাভেদের হাত ধরেই। তাই তাঁদের নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রের নাম যে ‘অ্যাংরি ইয়ংমেন’ই হবে, সে আর আশ্চর্য কী!
২০ আগস্ট ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পাওয়া তিন পর্বের তথ্যচিত্রে সেলিম-জাভেদের কাজের সঙ্গে আলো ফেলা হয়েছে তাঁদের ব্যক্তিজীবনেও। এই দুই চিত্রনাট্যকার ছাড়াও ‘অ্যাংরি ইয়ংমেন’-এ কথা বলেছেন নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, সমালোচক থেকে শুরু করে অনেকেই। নর্মতা রাও পরিচালিত এই তথ্যচিত্রে কথা বলেছেন সেলিম খানের পুত্র সালমান খান, জাভেদ আখতারের পুত্র-কন্যা ফারহান আখতার ও জোয়া আখতার।
যেভাবে ‘অ্যাংরি ইয়ংমেন’
১৯৭৩ সালের মে মাসে মুক্তি পেয়েছিল সত্তর দশকের অন্যতম হিট ছবি ‘জঞ্জির’। এই ছবির সুবাদেই রাতারাতি তারকা হয়ে গিয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় শুরু হয়েছিল ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ নায়কের সূচনা। যে নায়ক অকারণে হাসে না, তথাকথিত রোমান্সে বিশ্বাসী নয়।
একরোখা, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সেই নায়ক পারদর্শী দুর্ধর্ষ অ্যাকশনে। বক্স অফিসে দারুণ ব্যবসা করে ‘জঞ্জির’, আপাতদৃষ্টে হিন্দি সিনেমার জন্য বেমানান নায়ক অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিয়ার খুঁজে পায় দিশা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, না অমিতাভকে, না সেলিম-জাভেদকে। পর্দায় তাঁদের ‘অ্যাংরি ইয়াং মেন’রা একের পর এক বাজিমাত করে গেছেন।
যেন হিট মেশিন
একসঙ্গে সেলিম-জাভেদ ২৪টি সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, যাঁর মধ্যে ২২টিই ব্লকবাস্টার হিট—এই অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছেন তাঁরা। এই জুটির সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল গান, রোমান্টিকতা–নির্ভর হিন্দি সিনেমা থেকে বেরিয়ে দর্শককে নতুনত্বের স্বাদ দেওয়া। তাঁরা যে কাজটি ভালোভাবেই পেরেছিলেন, সেটা তাঁদের সাফল্যের হার দেখলেই বোঝা যায়।
১৯৮২ সালে বিচ্ছেদের আগ পর্যন্ত এই জুটি ‘দিওয়ার’, ‘ডন’, ‘শোলে’, ‘ত্রিশুল’, ‘দোস্তানা’র মতো সিনেমা উপহার দিয়েছেন। তথ্যচিত্রটির ট্রেলারেই দেখানো হয়েছেন, নিজেদের সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো বাস্তবেও সেলিম-জাভেদ ছিলেন ‘অ্যাংরি ইয়াং মেন’।
তাঁরা ছিলেন প্রতিষ্ঠাবিরোধী, সত্তর দশকে ভারতের ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষের প্রতিনিধিত্ব করেছিল তাঁদের চিত্রনাট্য। – করণ জোহর
জীবনের গল্প, সিনেমারও
সেলিম খান ও জাভেদ আখতার—দুজনই মুম্বাইয়ের বাইরে থেকে শহরটিতে এসেছেন। দুজনই শুরু থেকেই বাড়ি থেকে খরচ নিতেন না, নিজের আয়ে চলতেন। এক বেলা খাওয়া, ঘিঞ্জি ঘরে রাত কাটানো, পয়সার অভাবে মাইলের পর মাইল হাঁটা, পরে দুজনেরই প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ—সব মিলিয়ে দুজনের জীবনের গল্পে অনেক মিল। সে জন্যই হয়তো তাঁরা মিলে গিয়েছিলেন একসঙ্গে, হয়ে উঠেছিলেন সত্তরের দশকের হিন্দি সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ।
তাঁরা ছিলেন ‘প্রতিষ্ঠাবিরোধী’, সেলিম-জাভেদের সাফল্যকে তথ্যচিত্রে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন নির্মাতা-প্রযোজক করণ জোহর। তাঁর ভাষ্যে, ‘সত্তর দশকে ভারতের ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষের প্রতিনিধিত্ব করেছিল তাঁদের চিত্রনাট্য।’ পোস্টারে লেখকদ্বয়ের নাম থাকাও সেলিম-জাভেদের প্রভাব বোঝা যায়, মনে করেন করণ।
সংলাপের জাদুকর
‘মেরে পাস মা হ্যায়’ সেলিম-জাভেদের লেখা তুমুল চর্চিত এ সংলাপটি শোনেননি এমন হিন্দি সিনেমার দর্শক কমই পাওয়া যাবে। এই সংলাপের প্রভাব কতটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সেলিম–জাভেদের হাত ধরেই অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিয়ার খুঁজে পায় দিশা। আইএমডিবি অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়েও সংলাপটি বলে নিজের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এ আর রাহমান। কেবল এ সংলাপই নয়, সমালোচক অনুপমা চোপড়া মনে করেন সেলিম-জাভেদের লেখার মূল জাদু ছিল সংলাপ। তাঁদের লেখা সিনেমা দেখে যাঁরা বড় হয়েছেন, সংলাপগুলো তাঁদের জীবনেরই অংশ হয়ে গেছে।
আক্ষেপ থেকেই গেল
তুমুল জনপ্রিয় এই চিত্রনাট্যকারেরা কেন আলাদা হয়ে গেলেন? বহুল চর্চিত এই প্রশ্নের উত্তর নেই ‘অ্যাংরি ইয়াং মেন’-এ। তেমনি নেই অমিতাভ বচ্চনের মুখে কোনো নতুন কথাও। অমিতাভ ছিলেন ‘অ্যাংরি ইয়াং মেন’ যুগের প্রাণভোমরা। কিন্তু সেই অমিতাভ তথ্যচিত্রে এসে নতুন কিছু জানাতে পারেননি।
সেলিম-জাভেদ যেমন তাঁদের কাজের জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন, তেমনি তাঁদের বিরুদ্ধে আছে নকলের অভিযোগও। এটা নিয়েও বিশদ কিছু নেই। মোটকথা, সেলিম-জাভেদের কাজ, তাঁরা কেন গুরুত্বপূর্ণ, এটা যত্ন করে তথ্যচিত্রটিতে তুলে ধরা হয়েছে; কিন্তু তাঁদের সমালোচনা নিয়ে খুব বেশি কিছু নেই।