বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়। বাংলার মাটিতে এর উদ্ভব ও বিকাশ। বাউল গান বাউলদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। মূলত সাংগীতিক চেতনা, ধর্মীয় আবেগ, দর্শন ও আত্মোন্নতির বাসনা বাউল গান রচনার মূল চালিকাশক্তি হলেও ভাষাভঙ্গির ও প্রকাশরীতির কারণে তাতে সাহিত্যের গুণও সঞ্চারিত হয়েছে।
‘দৃশ’ ধাতু থেকে দর্শন শব্দের উৎপত্তি। ’দৃশ’ ধাতুর অর্থ দেখা। আমরা চর্ম চক্ষু দ্বারা তা দর্শন করি বটে, তবে তা শাস্ত্রীয় দর্শন নয়। দর্শন শাস্ত্রে দ্রষ্টার মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির প্রতিফলন থাকে। একজন ব্যক্তি জগৎ-জীবন-সংসারকে কিভাবে দেখে অথবা দেখার পর তার মনে কিরূপ ভাবের সঞ্চার হয় তাতেই প্রকৃত দর্শনের উৎস নিহিত আছে। বাউলরা উপাসক সম্প্রদায় হওয়ায় তাদের দর্শন ধর্মভিত্তিক। তারা অধ্যাত্নবাদী, তাই তারা অন্তর্মুখী চেতনা লালন করে। বাউলরা জগত- সংসারকে তাদের এরূপ ধর্মীয় চেতনার আলোকেই দেখে। তাদের আরাধ্য পরমাত্মা কোন শাস্ত্রীয় দেবতা নন। তিনি বিশ্বলোলোকেই ব্রক্ষসত্তারূপে আর মানবদেহে আত্মারূপে বিরাজ করেন।
বাউলরা ধর্ম নির্দেশিত বেদ-কোরআন সম্পূর্ণ মেনে চলে না, সমাজ নির্দেশিত জাত-পাত মানে না। বরং এসবের বিরোধিতা করেই বাউলরা নিজেদের ধর্মমত ও জীবনদৃষ্টি গড়ে তুলেছে। তারা স্বাধীন ও মুক্ত মনের অধিকারী; গৃহী হয়েও বৈরাগ্যপন্থী। ভিক্ষালব্ধ অন্ন উত্তম বিবেচনা করেন। সাধারণ গৃহীর সংসারের বন্ধনে তারা আবদ্ধ নয়। যে বাউল, তার দর্শন কি হতে পারে? বাউল দর্শনে তিনটি রূপ স্পষ্ট: মানবতা (humanism), ইহজাগতিকতা (secularism) ও বৈরাগ্যবাদ (nihilism)।
শাস্ত্রে বাহ্য ধর্ম-কর্মের ওপর জোর দেয়, বাউলরা অন্তধর্মের কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ প্রকারান্তরে বাউলদের অন্তর্মূখী ‘হৃদয়ধর্মে’র কথাই বলেছেন। বাউল দর্শনের উৎস এই হৃদয়ধর্মে নিহিত আছে। ধর্ম-কর্ম, জাত-পাত, বর্ণ-বিত্ত, রক্ত-বংশ, পেশা-বৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ে মানুষে মানুষে কত দ্বন্দ্ব-বিবাদ-দূরত্ব-অমিল। ভারতবর্ষে বিশ্বের প্রধান চারটি ধর্মের প্রভাব আছে- একেশ্বরবাদী ইসলাম, পৌত্তলিকতাবাদী হিন্দুধর্ম, ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টধর্ম এবং নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধধর্ম। প্রতি ধর্মেরই শাস্ত্র, উপাসনালয় ও তীর্থস্থান আছে। বাউলরা বেদ-কোরআন, মন্দির-মসজিদ, মক্কা-কাশির ব্যবধান মানে না। তাদের অন্তরবাসিনী দেবতা দেহেই আছেন; তাকে পাওয়ার জন্য অন্যত্র খোঁজার আবশ্যক নেই। তিনি যেহেতু সকল মানবদেহেই আছেন, সেহেতু মানবজীবন ও মানবদেহকে অবহেলা করা যায় না। উপরন্তু মানুষে মানুষে ভেদসৃষ্টিকারী প্রবৃত্তিসমূহকে ধ্বংস করে ‘সোনার মানুষ’ গড়তে হবে। সোনার মানুষ হলে ‘মনের মানুষকে পাওয়া সহজ হয়। বাউলের মানুষতত্ত্বে ব্যক্তি-মানুষ আর পরম-পুরুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
বাউল গানে ইহমূখী মানবতার কথা যেমন আছে তেমনি ইহবিমুখ বৈরাগ্যের কথাও আছে। অর্থাৎ তারা যেমন মানবতাবাদী (humanist), তেমনি বৈরাগ্যবাদী (nihilist)। আপাতদৃষ্টিতে তা স্ববিরোধী মনে হতে পারে। বাউলগণ যে ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করত, তা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। এ ব্যবস্থার ভেদাভেদের ও শোষণ-বঞ্চনার অজস্র বেড়াজালের মধ্যে এই বৈরাগ্যের ও নৈরাশ্যের বীজ নিহিত ছিল। নিষ্ঠুর সামন্ততান্ত্রিক সমাজ-শাসন, ধর্মশাসনের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ আছে, কিন্তু নতুন করে গড়ার স্বপ্ন নেই। তারা পালিয়ে গিয়ে বিবাগী হয়ে জীবন কাটাতে চায়; সমাজ-সংসারে বিরাজমান হতাশা ও নৈরাশ্য তাদের এরূপ ভাবাবেগের জন্ম হয়। বাউলরা মানবজন্মকে গুরুত্ব দেয় কিন্তু সংসার বন্ধনকে মানতে চায় না।
বাউলদের নৈরাশ্যবাদ এক অর্থে মানবতাবাদের পরিপোষক। জাগতিক মোহ ভগবৎ প্রেমের পথে বাধাস্বরূপ। সংসার বন্ধন ছিন্ন করে ভগবৎ সত্তার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ বাউল সাধনার মূল লক্ষ্য। তাকে সর্বস্বভাবে না পাওয়ার জন্যেই বাউলের কল্পনা। গগন হরকরা বলেন: “আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে। হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।”
সবশেষে এটাই বলা যায় যে এখানে ঘর নেই, পথ আছে। বাউলরা অন্তহীন পথের পথিক। সাংসারিক মানুষ ভোগের সামগ্রী না পেলে নৈরাশ্যবাদী হয়। বাউলের নৈরাশ্যবাদ ভগবৎ-সত্তাকে না জানা, না পাওয়ার জন্যে। জাগতিক মানুষের কাছে তাই তারা বিবাগী, কিন্তু নিজেদের কাছে তারা মুক্তি সন্ধানের পথিক। রবীন্দ্রনাথ তার স্বকীয় নানা সৃষ্টিতে বাউল বৈরাগীকে এরূপ মুক্তি ও আনন্দের প্রতীক রূপেই চিহ্নিত করেছেন। তারা নিজেরা মুক্ত থেকে অন্যকে মুক্তির পথ দেখায়।
“এসো নিজকে নিজে চিনি” অনলাইন সংগঠন প্রায় পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে অনলাইনের বিভিন্ন এ্যাপসের মাধ্যমে বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে বাউল গান ও তার মহত্ব ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। এই অনলাইন সংগঠনটির মূল মুখপাত্র রেজাউল করিম রানা, অনলাইন এ যাকে দয়ালের পাগল রানা হিসেবেই চেনেন সকলে। রানার উৎসাহে, উদ্দিপনায় বাংলাদেশে বসবাসকারী, প্রবাসী ও পশ্চিম বঙ্গের কিছু বাউল গান প্রেমীদের একত্রিত করে তিন বছর যাবৎ বাউল গানের প্রতিভা অন্বেষণ করে আসছে।
এবছর বিগো লাইভ এ্যাপস এ চলছে তার তৃতীয় আসর। এই আসরেও চলছে অনলাইন এ্যাপস বিগো লাইভ ব্যবহারকারী দের মধ্যে বাউল গানের প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় থাকছে আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা।
“এসো নিজকে নিজে চিনি” পরিবার আয়োজিত বাউল গানের ৩য় আসরের আয়োজনে আয়োজক কমিটিতে রয়েছেন-প্রধান উপদেষ্টা এম কে মুরাদ, আয়োজক- ইসমাইল, আলী, পাগল শরীফ, মহসিন, আরিফুল ইসলাম, জসিম, শামীম, কবির, ফরিদুল আলম ফরিদ, হক সাহেব, হাসন রাজা, পারভেজ, আলী কোলকাতা, নাজিম, সুজন বন্ধু, মুজিব শাহ্ ও দয়ালের পাগল রানা।
এ আসরে বিচারক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন- (১) বাউল সাধক আলমাস সরকার, (২) বাউল শিল্পী লতা দেওয়ান ও (৩) বাউল শিল্পী সুজন সরকার।
উক্ত আসরের ব্রডকাষ্টার হিসেবে সর্বক্ষণ ব্রডকাষ্টিং পরিচালনা করছেন দয়ালের পাগল রানা, উপস্থাপনায় হাসন রাজা। সমগ্র অনুষ্ঠানের মিডিয়া কাভারেজ (মিডিয়া পার্টনার) ও দিক নির্দেষনার সহযোগিতায় আছে “জনতার নিঃশ্বাস” (www.janatarnissash.com) ও জনতার নিঃশ্বাস সম্পাদক ফরিদুল আলম ফরিদ (বিগো আইডি রোমিও রাজবাড়ী)।
দীর্ঘ প্রায় দুই মাস ধরে বিগো লাইভ এ্যাপ্স এ আসর চলছে। আগামী ২০ অক্টোবর ২০২১ প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ড অর্থাৎ গ্রান্ড ফিনালে অনুষ্ঠিত হবে।
বাছাইপর্ব থেকে ১ম রাউন্ড এবং ১ম রাউন্ড থেকে ২য় রাউন্ড, এরপর ২য় রাউন্ড থেকে ৩য় রাউন্ড এবং ৩য় রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছেন সিঙ্গার শুভ (কিশোরগঞ্জ) ও কাতার প্রবাসী মোঃ ইয়াসিন (বরিশাল)। আর ৩য় রাউন্ডে অনুপস্থিত ছিলেন সিঙ্গার রেজা (ঢাকা) ও ঝুমা কলিজা (গোপালগঞ্জ)। যে ৮ জন সুপার টেন এ লড়ছেন, তারা হলেন- ১. সিঙ্গার মুন (সিলেট), ২. আরিফ (বাগেরহাট), ৩. প্রজাপতি (বগুড়া), ৪. বাউল মন ইদ্রিস (চাঁদপুর), ৫. আলতাফ সরকার (ফরিদপুর), ৬. সুজন (গাইবান্ধা), ৭. টুকটুকি আঁখি (রাজশাহী), ৮. সুরের পথিক (নাটোর)।
এই আট প্রতিযোগীর মধ্য থেকে বিচারকদের রায়ে ও প্রাপ্ত নাম্বার পেয়ে ফাইনাল রাউন্ডে ৪জন যায়গা করে নেয়। নিয়মানুযায়ী ৫ জনকে ফাইনাল রাউন্ডে উন্নিত করার কথা থাকলেও ৩য় রাউন্ডে ৫ম স্থান অর্জন করেন অর্থাৎ একই নাম্বার ২জন প্রতিযোগী পান। গতকাল সেই দুই জন (সুজন ও সিঙ্গার মুন) এর মাঝে আবার অডিশন নেয়া হয়। এখানে সুজন (গাইবান্ধা) সবার চেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে ফাইনাল পর্বে উন্নিত হন। বাদ পরে জান সুনামগঞ্জের মেয়ে সিঙ্গার মুন।
ফাইনালে যে ৫জন মোকাবেলা করবেন তারা হলেন-
০১. সুজন, প্রাপ্ত নাম্বার- ২৮.৮ (৩০ এর মধ্যে)
০২. সুরের পথিক, প্রাপ্ত নাম্বার- ২৮.২
০৩. টুকটুকি আঁখি, প্রাপ্ত নাম্বার- ২৮.২
০৪. প্রজাপতি, প্রাপ্ত নাম্বার- ২৭.০
০৫. বাউল মন ইদ্রীস, প্রাপ্ত নাম্বার- ২৬
আগামী ২০ অক্টোবর ২০২১ ইং, রোজ বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১ টায় শুরু হবে উক্ত আসরের ফাইনাল রাউন্ড অর্থাৎ গ্রান্ড ফিনালে। গ্রান্ড ফিনালে দেশের সঙ্গীত অঙ্গনের অনেক তারকা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন বলে আয়োজক কর্তৃপক্ষ জানান।